
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে সংলাপে বসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসময় পর্যবেক্ষক সংস্থার উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, পর্যবেক্ষকরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে সবকিছু ড্যামেজ হয়ে যাবে। তাই এরকম কাউকে দয়া করে নিয়োগ দেবেন না। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে সংলাপের শুরুতে তিনি এসব কথা বলেন। এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন খুব রাজনীতি সচেতন। আপনারা যাদের নিয়োগ দেবেন তারা যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সবকিছু ড্যামেজ হয়ে যাবে। তাই দয়া করে চেক করবেন তারা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কিনা, কোনও মিছিল, মিটিং এ গেছে কিনা, কোনও লিংক আছে কিনা। এরকম কাউকে দয়া করে নিয়োগ দেবেন না। আপনাদের লোকজন যাতে কোনও দলীয় প্রচারণা প্রচার প্রসারণে না যায়, ভোটারদের প্রভাবিত না করে, কোন মার্কায় ভোট দাও এসব না করে। তাদের বুঝিয়ে দেবেন এসব করার দায়িত্ব তার না। উনি শুধু রিপোর্ট করবেন।
সিইসি বলেন, আপনারা সবাই বাংলাদেশি, একটা সুন্দর নির্বাচন নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। বাংলাদেশের বাস্তবতাও বিবেচনা করে রিপোর্টিং করতে হবে। আমেরিকা, ইউকে বা ইউরোপীয় কনটেক্সট চিন্তা করে রিপোর্ট করলে সমস্যা হবে। আমাদের দেশের লিমিটেশনস, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে স্মার্ট, ইমপ্লিমেন্টেবল রিপোর্টিং করতে হবে। আপনাদের অভিজ্ঞতা আছে, আপনারা সমাজের বিশিষ্ট লোক, সংস্থার নেতৃত্বে আছেন। আপনাদের কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট, এসিআর নির্ভর করবে আপনাদের লোকজনের কর্মকাণ্ডের ওপর। তাই তাদের মনিটরিং আপনাদের করতে হবে।
তিনি বলেন, যদি কোনও রিপোর্ট আসে যে আপনার অবজারভার কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছে, ইনফ্লুয়েন্স করছে, তাহলে তো সমস্যা। তাই নিশ্চিত করবেন তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকে। আমাদের একটাই অ্যাজেন্ডা, একটি ক্রেডিবল, সুন্দর, ট্রান্সপারেন্ট নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া। সেটা সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। কোন ল্যাপস কোন স্টেজে হচ্ছে, আচরণ বিধির স্টেজে, পোলিং স্টেজে, ভোটের লাইনে, বাক্স হ্যান্ডলিং, কাউন্টিং বা ক্যালকুলেশনের স্টেজে এসব আপনারা বুঝিয়ে দেবেন আপনাদের লোকজনকে।
তিনি আরও বলেন, আমি সবসময় বলি, আমার সিসি ক্যামেরা হচ্ছে অবজারভার, আমার সাংবাদিক ভাই–বোনেরা। এরা যদি চোখ খোলা রাখে কেউ নিয়ম ভাঙতে সাহস পাবে না। ইনশাল্লাহ আমরা সবাই মিলে একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবো। আপনাদের সহযোগিতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, এই নির্বাচনে আমাদের তো নিজস্ব সুপারভাইজারি মেকানিজম থাকবে। অফিশিয়াল মেকানিজম থাকবে, আমাদের কমিশনের রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আমাদের ইলেক্ট ম্যাজিস্ট্রেসি ইত্যাদি থাকবে। কিন্তু আপনাদের চোখ দিয়েও আমরা নির্বাচনটা দেখতে চাই। আপনাদের চোখ যদি দুষ্ট না হয়, প্রভাবিত না হয়, তাহলে আপনাদের নির্বাচন দেখাটাও সঠিক হবে।
তিনি বলেন, এখানে অনেক পুরানো সংস্থা আছেন যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি অতীত নিয়ে কোনও ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। আমি অলওয়েজ সামনের দিকে তাকাতে চাই। অতীতের ভুলভ্রান্তি আমাদের অনেক হয়েছে। এটা হতে পারে, নানান কারণে হতে পারে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনে এগোতে চাই।
সিইসি বলেন, নির্বাচনে যারা জড়িত থাকবে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত তাদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে আপনারা রিপোর্ট করবেন। ট্রান্সপারেন্ট ওয়েতে আমাদের কাজকর্মগুলো হচ্ছে কিনা, নির্বাচনি আইন, ইলেকশনটা কনডাক্ট হচ্ছে কিনা, আমাদের যে অফিসার, পুলিশ অফিসার এদের পারফরম্যান্সটা আইন অনুযায়ী হচ্ছে কিনা, শাসনতন্ত্র অনুযায়ী হচ্ছে কিনা, আরপি অনুযায়ী হচ্ছে কিনা। সুতরাং আপনাদের রিপোর্টিংয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ইতিহাসের সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন হবে ২০২৬ সালে- সানাউল্লাহ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা করলে তাকে ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না বলেও তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ পর্যবেক্ষকদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়ে বলেন, কোনো পর্যবেক্ষক ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করতে পারবে না। পর্যবেক্ষকদের তালিকা তফসিল ঘোষণার ১০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। মানহীন পর্যবেক্ষক নির্বাচনে প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু মানসম্পন্ন ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ চাই। এছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিক দেশি সংস্থার হয়ে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বিদেশি নাগরিকদের অবশ্যই বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের নিজস্ব আইন-বিধিতে আবেদন করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে জানান তিনি। পর্যবেক্ষকদের দায়িত্বের সময়সীমা নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশনার জানান, নির্বাচনের আগের দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরের দিন— এই তিনদিন পর্যবেক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া, ভুয়া পর্যবেক্ষকদের চিহ্নিত ও ঠেকানোর জন্য নির্বাচন কমিশন এবার কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে। পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্রে কিউআর কোড ব্যবহার করা হবে, যা জালিয়াতি প্রতিরোধে সহায়তা করবে জানান আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে লিগ্যাল নোটিশ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী) ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব এ নোটিশ পাঠিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট, সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী নাঈম সরদার এবং শাহ্ সারোয়ার সালফ শাওনের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ই-মেইলে জনস্বার্থে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্বাচনে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী) ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক ও আইনগত দায়িত্ব। কিন্তু নোটিশ গ্রহীতাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে দেশের প্রায় ৩০ লাখ প্রতিবন্ধী ভোটার নির্বাচনে কার্যকর অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ৩০ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী ভোটার রয়েছেন, যাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী ভোটার ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। দেশের ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী ভোটার নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে গণতন্ত্র চর্চায় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী নাগরিকের মতামত রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নোটিশ গ্রহীতাদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিধান থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার কারণে প্রতিবন্ধী ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।