
শরীয়তপুরের কৃষি খাতে নতুন আশার আলো জ্বেলেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে জেলায় স্থাপিত চারটি মিনি কোল্ড স্টোরেজ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, ফসল সংরক্ষণ এবং সবজি চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এসব কোল্ড স্টোরেজ এরইমধ্যে কৃষকদের মধ্যে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনকারী কৃষকরা বলছেন, দুর্গম চরাঞ্চলে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে পারলে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি লাভবান হবেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তি তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শরীয়তপুরের সবজি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় নানামুখী সংকট তৈরি হয়। অনেক সময় চাষিরা নিম্নমূল্যে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফসল সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত সবজির একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় নির্মিত মিনি কোল্ড স্টোরেজগুলো কৃষকদের জন্য সত্যিকারের আশীর্বাদ হয়ে উঠছে।
প্রকল্প সূত্রে জানাগেছে, ২০২৫ সালের জুন মাসে দেশব্যাপী শরীয়তপুরসহ ২৪টি জেলার ৪৮টি অধিক সবজি উৎপাদনকারী উপজেলায় মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। গত ১৬ নভেম্বর সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে সবজি সংরক্ষণ শুরু করা হয়। এরই ধারবাহিকতায় গত মঙ্গলবার শরীয়তপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিস সম্মেলন কক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন, ফসল উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মিনি কোল্ড স্টোরেজ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শরীয়তপুরের উপ-পরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও জেলার সব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি বিপনন কর্মকর্তা, কৃষি সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্মকর্তারা ও কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনকারী কৃষকরা উপস্থিত ছিলেন।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার আর্শীনগর ইউনিয়নের মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনকারী কৃষক নিজাম গাজী বলেন, গত ১৬ নভেম্বর থেকে আমার কোল্ড স্টোরেজে বেগুন, শশা, লাউ ও কাচামরিচ সংরক্ষণ শুরু করেছি। ১০ দিনেও সবজি সতেজ ও চকচকে রয়েছে। এখন থেকে ভরা মৌসুমে আমাদেরকে আর কমদামে বাধ্য হয়ে সবজি বিক্রি করতে হবে না। যখন ভালো দাম পাব তখন বিক্রি করব। এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ যদি সঠিকভাবে চলে তাহলে আমাদের সবজি বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ পাব। জাজিরা উপজেলার মুলনা ইউনিয়নের মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনকারী কৃষক মো. জলিল মাদবর বলেন, আগে ভরা মৌসুমে দালালদের সিন্ডিকেটের কারনে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়েও কম দামে সবজি বিক্রি করে দিতে হতো। এখন আর দালালদের সুবিধামতো না আমাদের সুবিধামতো যখন বেশি দাম পাব তখন বিক্রি করতে পারব। তবে সরকার যদি দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে এরকম মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করে দেয়, তবে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বি হতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি প্রকল্পের সিনিয়র মনিটরিং অফিসার জামাল হোসেন বলেন, এরইমধ্যে কৃষকরা মিনি কোল্ড স্টোরেজের সুবিধাও ভোগ করতে শুরু করেছেন। দুইটি কাঠামোতে এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা হয়েছে। কক্ষভিত্তিক মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন ব্যয় ৬ লাখ টাকা ও কনটেইনার ভিত্তিক মিনি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন ব্যয় প্রায় ১৬ লাখ টাকা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সব সবজি সংরক্ষণ করা যাবে তা হলো লাউ, শসা, কাচামরিচ, শশা, টমোটো, পেপে, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর। এছাড়াও মৌসুমী সবজি সংরক্ষণ করা যাবে। সবজির প্রকার ভেদে এক সপ্তাহ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে সুবিধা মতো সময়ে বিক্রি করতে পারবেন কৃষক।
কৃষকরা সাশ্রয়ী এই কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি শুধু ফসল সংরক্ষণই নয়, তাদের আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখন তারা বাজারে সঠিক সময়ে পণ্য দিতে পারবেন এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। ফলে মৌসুমে মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম অনেকটাই কমে আসবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শরীয়তপুরের উপ-পরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকির এই সময়ে কৃষকের উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণে মিনি কোল্ড স্টোরেজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সবজি বাজার ব্যবস্থাপনায়ও আসবে আমুল পরিবর্তন। এখন আর ইচ্ছে করলেই ভরা মৌসুমে দালাল চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃষককে ঠকাতে পারবে না। কৃষক তার উৎপাদিত সবজির ন্যয্যমূল্য পেয়ে স্বাবলম্বী হতে পারবে। পরিবর্তন এসবে দীর্ঘ দিনের দালাল চক্রের ভরা মৌসুমের সিন্ডিকেট প্রতারণার।