
শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সারা বিশ্বেই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই ক্যান্সার রোগীদের যথাযথ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অধীনে একটি স্বতন্ত্র ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীনে তাদের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট রয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর যেসব দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রায় সবখানেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট রয়েছে। ফলে উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে আমরাও বিএমইউ’র অধীনে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।’ ক্যান্সার রোগীদের সংখ্যা দিন দিন কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান সতর্ক করে বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন ক্যান্সার রোগী থাকবে। বিষয়টি অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও সেই শঙ্কা এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ সে সময় আর বেশি দূরে নয়।’
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারের এই ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে প্রধান কারণ তামাক ও ভেজাল খাদ্য দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারের সঙ্গে ধূমপান ও তামাক সেবনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তবে এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো আমাদের খাদ্যচক্রে মিশে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার, কোথাও যেন নিরাপত্তা নেই। দুধ ফরমালিন, মাছে ফরমালিন, পানিতে আর্সেনিক এবং ফসলে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’
খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন আরো বলেন, ‘জামালপুরের বেগুন ক্ষেতের মাটিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সিসা, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, তামা ও দস্তার মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। মূলত সার ও বালাইনাশকের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর উপাদান ফসলে প্রবেশ করছে, যা রান্নার পরও নষ্ট হয় না। এছাড়া রাস্তার ধারের মুখরোচক খাবার, যেমন বেগুনি বা জিলাপি ভাজতে দিনের পর দিন একই পোড়া তেল (ব্রেক অয়েল) ব্যবহার করা হচ্ছে। মুড়িকে ধবধবে সাদা করতে মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া। ফল পাকানোর জন্য ইথিলিন ও অন্যান্য টক্সিক সাবস্ট্যান্স (বিষাক্ত পদার্থ) ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি আমরা চা বা গরম পানীয় খাওয়ার জন্য যেসব ওয়ান-টাইম প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করি, তাতে গরম চা বা পানি ঢাললে প্লাস্টিক থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদান নির্গত হয়, যা অজান্তেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দূষিত বাতাস হলো ঢাকা শহরের বাতাস। বলা হয়ে থাকে, একজন মানুষ ধূমপান করলে যতটা ক্ষতি হয়, ঢাকার দূষিত বাতাস তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে। কেননা, গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড বাতাসের মান নষ্ট করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য। ট্যানারির বর্জ্য বা ঝুট পুড়িয়ে অবৈধভাবে পোল্ট্রি ফিড তৈরি করা হচ্ছে, যার মধ্যে ক্রোমিয়ামের মতো মারাত্মক ভারী ধাতু থাকে। এই খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠা হাঁস-মুরগি, মাছ কিংবা গবাদিপশুর মাংস যখন আমরা খাচ্ছি, তখন পরোক্ষভাবে সেই বিষ আমাদের শরীরেই ঢুকছে। বিশেষ করে যাদের ফাস্টফুড পছন্দ, তারা এই বিষক্রিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন।’ তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে উল্লেখ করে ডা. আকরাম বলেন, ‘সাধারণত ৭০ বছরের বেশি বয়সে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে এখন ৫০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যেও ক্যান্সার আক্রান্ত হারের সংখ্যা বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে খাদ্যে ভেজাল যেমন বড় সমস্যা, তেমনি পেশাগত ঝুঁকিও ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। উদাহরণ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির কথা উল্লেখ করেন। সেখানে ভাঙা জাহাজের ভেতরের নানা সামগ্রীতে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসবেস্টস থাকে। এই জাহাজগুলো কাটার সময় অ্যাসবেস্টসের সূক্ষ্ম কণা বাতাসে ওড়ে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের ফুসফুসে প্রবেশ করে, যা ফুসফুসের ক্যান্সারের নিশ্চিত কারণ। সরকারি আইন অনুযায়ী অ্যাসবেস্টসযুক্ত জাহাজ দেশে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিন্তু সেই আইন যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বিধায় হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে সংক্রমণজনিত কারণেও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে।