ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভোটে থাকছে তিন স্তরের নিরাপত্তা

ইসির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক
ভোটে থাকছে তিন স্তরের নিরাপত্তা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন থাকার পাশাপাশি নির্বাচনি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ও ‘রিজার্ভ ফোর্স’ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাখা হবে। একইসঙ্গে তফসিল ঘোষণা হলে প্রথম দিন থেকে আচরণবিধি প্রতিপালনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তিন ঘন্টাব্যাপী আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তি ও প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন; সেখানে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসময় চার নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন-ইসি সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ভিডিপি, কোস্টগার্ড, র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা/বিভাগের প্রধান ও প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠক শেষে ‘আইন শৃঙ্খলা মোতায়েন পরিকল্পনা, সমন্বয়, দিকনির্দশনামূলক সভার’ সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ইসি স্পষ্ট বার্তা হচ্ছে-একটা সুষ্ঠ সুন্দর, সার্বিক উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনকে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা সবাইকে করতে হবে এবং নিজস্ব দায়িত্ব নিজের আওতায় পালন করতে হবে। (ব্যত্যয় হলে) কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’

ইসি সচিব বলেন, নির্বাচনি এলাকায় তিন ধরনের মোতায়েন পরিকল্পনা তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আমাদের মোতায়েন পরিকল্পনায় হচ্ছে তিনটা অংশ। ভোটকেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ, আরেকটা হচ্ছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ। আমাদের গাইডলাইনটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট বাহিনী থেকে এটা করবে। আর এর সাথে প্রচলিত অর্থে যেটা ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ বলি সেটাও এই তিনটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কবে তফসিল ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে আখতার আহমেদ বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার খবরটা যখনই আমি পাবো, তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাদের জানিয়ে দেব।’

ভোটের নিরাপত্তায় কত সদস্য: এবারের নির্বাচনে পৌনে ১৩ কোটি ভোটার রয়েছে। ৩০০ আসনে প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে দুই লাখ ৬০ হাজারের মতো ভোটকক্ষ থাকবে। প্রাথমিক সভায় ভোটের আগে-পরে আট দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব আসে এবং ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৩ থেকে ১৮ জন সদস্য রাখার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ লাখের বেশি সদস্য ভোটে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে আনসার-ভিডিপি সদস্যদের সংখ্যাই হবে সাড়ে ৫ লাখের মত। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৯০ হাজারের বেশি। এছাড়া পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা তদারকি কীভাবে: সভায় আইনশৃঙ্খলা মোতায়েনের সার্বিক বিষয় আলোচনা হয়েছে তুলে ধরে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলার সাথে সম্পর্কিত এজেন্সিগুলো সবার সাথে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত প্রস্তুতি আলোচনা এটাই শেষ। এর পরে প্রয়োজনে হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট অবস্থায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সাথে বসবেন তারা। তিনি বলছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূল ভূমিকায় থাকলেও তদারকির দায়িত্বে থাকবে ইসি। বৈঠকে মোটা দাগে যে জিনিসগুলোকে বলা হয়েছে সেসব তুলে ধরে আখতার আহমেদ বলেন, “সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে ‘লিড মিনিস্ট্রি’ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন করবে। তারা ‘গাইডলাইনস, প্রিন্সিপালস’ যেগুলো আছে কীভাবে কী কাজ করবেন, না করবেন সে সম্পর্কে তারা অন্যান্য বারের মতো দিকনির্দেশনা দেবে। নির্বাচনন কমিশনে আমরা, সার্বিক তদারকি ও সমন্বয়টা আমরা দেখবো।”

ইসির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ‘মনিটরিং সেল ও সাইবার সিকিউরিটি সেল’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অপতথ্য-গুজব-মিথ্যা রোধে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে সব বাহিনী ও সংস্থার প্রতিনিধিদের উচ্চ পযায়ের কেন্দ্রীয় ‘মনিটরিং সেল’ থাকবে, বলেন ইসি সচিব।

তিনি বলেন, এখানে আমরা একটা ‘মনিটরিং সেল’ করব। আর সেই সাথে ‘মনিটরিং সেল’গুলোর সাথে আবার সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর একটা সংশ্লিষ্টতা, সমন্বয়টা থাকবে। এখন ‘সেলের সাইজ’ কত হবে, কতজনের প্রতিনিধি হবে এটা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্টভাবে এখনো বলা হয়নি প্রতিনিধিদের। সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে যারা যে সংখ্যাটা আসবে, আমরা সেভাবে এটা সমন্বয় করে নেব।

‘সাইবার সিকিউরিটি সেল’ থাকবে তুলে ধরে ইসি সচিব বলেন, সাইবার সিকিউরিটি’ সেল, যেখানে সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো তদারক করা হবে, অপতথ্য থেকে যেন মুক্ত থাকতে পারি। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপির সাথে একটা ওদের প্ল্যাটফর্ম আছে, সেটা ব্যবহার করব। ইসির নিজস্ব সক্ষমতা যেটা আছে তথ্য মন্ত্রণালয়, সিআইডি এবং অন্যান্য যে এজেন্সি ফ্যাক্ট চেকের ব্যাপারে, যে সমস্ত সক্ষমতা আছে, সেগুলো আমরা সমন্বয়ক করব।

তিনি বলছেন, সঠিক তথ্য সরবরাহ ও তা তৃণমূলে পৌঁছে দিতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কর্মকৌশলও রয়েছে ইসির।

ইসি সচিব বলেন, যোগাযোগ কৌশল হবে দুটি। উপর থেকে নিচে যাবে, একদম নিচের স্তর পর্যন্ত, যেখান থেকে আবার উপরে আসবে এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয়টা সেইভাবে হবে।

তিন স্তরে মোতায়েন, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা: নির্বাচনি এলাকা ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় বাহিনীর সদস্যদের কেন্দ্রে রাখার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ও রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করবে ইসি। সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ইসির মোতায়েন পরিকল্পনায় মূলত তিনটি ভাগ রয়েছে। একটা স্থির অবস্থায় থাকবে, যা কেন্দ্রভিত্তিক, কেন্দ্রে কিছু নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন থাকবেন। এর সঙ্গে থাকবে চেকপোস্ট, বিভিন্ন চেকপোস্টের মাধ্যমে, কোনো স্থানে চেকপোস্ট হতে পারে, মোবাইল চেকপোস্ট হতে পারে। মোবাইল চেকপোস্ট হলে হয়তো এক জায়গায় করা হল; সেখান থেকে আবার দুই কিলোমিটার দূরে, সেটাও আবার স্থির অবস্থার চেকপোস্ট হবে।

পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভ্রাম্যমাণ রাখার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, মোটামুটিভাবে তারা ঘুরে ঘুরে ঘুরে দেখবে। কেন্দ্রগুলোর ভৌগলিক অবস্থান, সেখানে যাওয়ার সড়ক, এসব সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে (৫-১০টা কেন্দ্রে ভাগ করে) সংশ্লিষ্ট বাহিনী ঠিক করবে। আর (তৃতীয়টি) আরেকটা থাকতে হবে ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ’।

এছাড়া ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার-এনটিএমসির অ্যাপকেও কাজে লাগাবে ইসি।

এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, পূজার সময় একটা অ্যাপ ডেভেলপ করেছিল সে অ্যাপটাও আমরা ব্যবহার করব। সাইবার সিকিউরিটির বিষয়টা নিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে।ৃসবসময় একটা ‘কন্টিনজেন্সি প্ল্যান’ (সম্ভাব্য ঘটনা মাথায় রেখে করা পরিকল্পনা) রাখার দরকার; যদি দুই তিনটা জায়গায় ঝামেলা হয়, তাহলে ‘কন্টিনজেন্সি প্ল্যানটা’ কাজে দেবে।

এই পরিকল্পনা থাকার দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প ব্যবস্থাটা যেন থাকে, প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারটা করা যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু জায়গায় মোবাইল ও ইন্টারনেট সুবিধার সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতি রাখার কথাও বৈঠকে বলা হয়েছে।

আখতার আহমেদ বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।

চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখার এবং আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্বাচনি ‘ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি’, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবেন। এর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রয়েছে।

বৈঠকে পোস্টাল ভোটিংয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে

এছাড়া বৈঠকে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠানোর ব্যাপারে রাস্তার নিরাপত্তা এবং এটা সম্পূর্ণভাবে নজরদারিতে রাখা, রিটার্নিং অফিসারের কেন্দ্রের কাছে যখন পৌঁছবেন, তার জিম্মায় যখন থাকবে, সেখানে নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করা এবং ভোট গণনার সময় যেন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাটা দেখা হয়- এই চারটা জিনিসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

ইসি সচিব বলেন, সারাদেশে একই দিনে ভোট হবে। গণভোট এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ভোট। কাজেই চলাচল বাড়বে সে ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে যানবাহনের স্বল্পতার বিষয়টা আছে। সরকারি দপ্তর ও স্থানীয়ভাবে ভাড়ায় সংগ্রহ করতে হবে।

সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বহাল রয়েছে: এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সামরিক বাহিনী থাকছে। তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া আছে ২৮ ফেব্রুয়ারি পযন্ত, সেটা বহল থাকবে।ৃআরপিও’র সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক হবে না। সাংঘর্ষিক হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ তিনি দেখছেন না। তিনি বলেন, মোতায়েন পরিকল্পনায় সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্বটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। রিটার্নিং অফিসারের সাথে তাদের (সামরিক বাহিনী) সমন্বয় করে কেন্দ্রে থাকতে হবে। ‘রিজার্ভ ফোর্স’ হিসেবে থাকবেন নাকি ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে থাকবেন, এটা ওরা ধাপে ধাপে তৈরি করে নেবেন। এটা আমরা ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’গুলো বলে দিয়েছি যে আমাদের প্রয়োজনটা হচ্ছে এইভাবে, আপনারা এইভাবে মোতায়েন পরিকল্পনাটা করেন, কতজন থাকবেন, কীভাবে থাকবেন না থাকবেন, এটা আরও পরবর্তী, পর্যাক্রমে আমাদের কাছে আসবে, সময়সীমা কতদিন থাকবেন সে সম্পর্কেও কোনো কিছু হয়নি, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তারা বলবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত