ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভূমিকম্পপ্রবণ যত দেশ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ভূমিকম্পপ্রবণ  যত দেশ

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পকে সব থেকে ভয়াবহ, প্রাণঘাতি ও ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা হয়। এ বিপর্যয় মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিতে পারে ভূদৃশ্য, অর্থনীতি ও মানুষের জীবন। বিশ্বের কিছু দেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা, পরিবারকে নিরাপত্তা পরিকল্পনা জানানো এবং সতর্ক সংকেত সম্পর্কে সচেতন থাকার মাধ্যমে ঝুঁকি এড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। যেসব দেশ সবথেকে ভয়াবহ কম্পনের ঝুঁকিতে রয়েছে, তা হলো-

চীন : সব থেকে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের তালিকায় ধরা হয় চীনকে। দেশটির পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে লংমেনশান এবং হিমালয়ান ফল্ট লাইন বরাবর ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। চীনে ভয়াবহ ভূমিকম্পের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ২০০৮ সালের সিচুয়ান এবং ১৯৭৬ সালের তাংশান ভূমিকম্প ভয়াবহ প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষতি ঘটিয়েছিল। ২০০৮ সালে সিচুয়ান প্রদেশে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ৮৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এটি ছিল সর্বকালের ১৮তম মারাত্মক ভূমিকম্প। চীন ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ, এটি একাধিক সক্রিয় টেকটনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত; যা ক্রমাগত ঘর্ষণ সৃষ্টি করে এবং পৃথিবীর স্তরের ওপর চাপ বাড়ায়। এছাড়া চীনের পাহাড়ি এলাকা ভূমিকম্প ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকে, যা প্রতিবেশী অঞ্চলেও প্রভাব ফেলে।

ইন্দোনেশিয়া : প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ারে’ অবস্থান করায় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় ভূকম্পন অঞ্চলের একটি। প্রায়ই দেশটিতে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ফলে সৃষ্টি হয় প্রাণঘাতী সুনামির। ২০০৪ সালে দেশটিতে সুমাত্রা ভূমিকম্প ও সুনামি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগগুলোর একটি। ৯.১ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের কারণে সমুদ্রের ঢেউ ৩০ ফুট (৯ মিটার) বা তার বেশি উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে জাভা দ্বীপে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এছাড়া ২০১৮ সালে ৬ মাত্রার চেয়ে বড় নয়টি ভূমিকম্প দেশটিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। রিং অব ফায়ারে অবস্থানের কারণে ভূমিকম্প ছাড়াও আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, খরা, বন্যা এবং সুনামির ঝুঁকিতে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়।

ইরান : আরব ও ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষ অঞ্চলে অবস্থান করায় ইরান অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। সে কারণে দেশটিতে গড়ে প্রতিবছর ২১০০টি কম্পন অনুভূত হয় বলে জানা গেছে। এরমধ্যে ১৫ থেকে ১৬টির কম্পনমাত্রা পাঁচ বা তার বেশি। রেকর্ড বলছে, ১৯৬৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ইরানে ৯৬ হাজার ভূমিকম্প হয়েছে। ১৯৯০ সালের মানজিল-রুদবার ভূমিকম্প দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। ৭.৪ মাত্রার ওই ভূকম্পনে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় তিন লাখের বেশি মানুষ। এছাড়া ২০০৩ সালের ভূমিকম্প ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায় দেশটিতে। কেরমানের বাম শহরে ৬.৭ মাত্রার ওই কম্পনে অন্তত ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

জাপান : জাপান বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ভূমিকম্প মোকাবিলা ব্যবস্থা গড়ে তুললেও দেশটি বিশ্বের শক্তিশালীতম ভূকম্পনের শিকার। রিং অব ফায়ারের ওপর অবস্থানের কারণে প্রায়ই শক্তিশালী ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় দেশটি। ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামি ছিল দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগের একটি। ৯.১ মাত্রার ওই ভূমিকম্প-সুনামিতে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ নিহত ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয় আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায়। সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট ক্যালিফোর্নিয়াকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে রাখে। আর আলাস্কায় উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলো রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া লস অ্যাঞ্জেলেস ও সান ফ্রান্সিসকোও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। ২০১৮ সালের আলাস্কায় ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তবে ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ অঙ্গরাজ্যটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিল, যার মাত্রা ছিল ৯.২। ৪ মিনিটের বেশি সময় স্থায়ী ওই ভূমিকম্পের পর সুনামি আঘাত হানে। এতে ১৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে।

তুরস্ক : উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্টের ওপর অবস্থিত হওয়ায় তুরস্কে ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ১৯৯৯ সালের ইজমিত ও ২০২৩ সালের কাহরামানমারাস ভূমিকম্প ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটিয়েছে দেশটিতে। ঐতিহ্যবহুল নগরী ও উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর জন্য ভূমিকম্প নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৩ সালে ৭.৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।

ভারত : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং হিমালয়ান বেল্ট ভূমিকম্পপ্রবণ। ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে টেকটোনিক সংঘর্ষের কারণে এ অঞ্চলে নিয়মিত শক্তিশালী কম্পন হয়। ২০০১ সালে দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল গুজরাট রাজ্যে। এতে মারা যায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এর আগে ১৯৫০ সালে অরুণাচল প্রদেশে দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড ৮.৬ মাত্রার শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়। তীব্র কম্পনের কারণে ব্যাপক ভূমিধস দেখা দেয় রাজ্যজুড়ে। সব মিলিয়ে মারা গিয়েছিল ৭৮০ জন মানুষ।

ফিলিপাইন : ফিলিপাইন নিয়মিত শক্তিশালী ভূমিকম্পের শিকার। কারণ, সি প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষ দেশটিকে সক্রিয় ভূকম্পন অঞ্চলে পরিণত করেছে। ১৯৯০ সালের লুজোন ভূমিকম্প এবং সাম্প্রতিক ২০২৪ সালে মিন্দানাও কম্পন দেশটির অবকাঠামোকে নড়বড়ে অবস্থায় ফেলে। ১৯৯০ সালের ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটিতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এছাড়া ১৯৭৬ সালে মিন্দানাও দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্পের ফলে সুনামি হয়। ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগটিতে ৮ হাজার মানুষ মারা যায় বা নিখোঁজ হয়।

পেরু : পেরু প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল নাজকা প্লেট ও দক্ষিণ আমেরিকান প্লেটের সাবডাকশন জোনে অবস্থান করায় নিয়মিত শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়ে থাকে। ২০০৭ সালের পিসকো ভূমিকম্পের কারণে দেশটির ৫০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটায়।

আফগানিস্তান : হিন্দুকুশ অঞ্চল টেকটোনিক সংঘর্ষের অন্যতম সক্রিয় এলাকা হওয়ার ফলে আফগানিস্তানে বারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৯৯৮, ২০০২, ২০২২ ও ২০২৫ সালের ভূমিকম্পে দেশটিতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। দুর্বল অবকাঠামো ও জরুরি সেবার সীমাবদ্ধতার কারণে কম মাত্রার ভূমিকম্পেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় দেশটিতে। ২০২২ সালে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয় আফগানিস্তানে এবং আহত হয় অন্তত তিন হাজার মানুষ। সর্বশেষ ২০২৫ সালের আগস্টের ভূমিকম্প সাম্প্রতিক সময়ে সব থেকে ভয়াবহ ছিল। দেশটির পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ২ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। এছাড়া নভেম্বরে ৬.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে দেশটিতে। ফলে প্রাণ যায় ২০ জনের বেশি মানুষের।

চিলি : বিশ্বের সব থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পটি অনুভূত হয় চিলিতি ১৯৬০ সালে। যার মাত্রা ছিল ৯.৫। ওই কম্পন ভালদিভিয়া ভূমিকম্প বা গ্রেট চিলির ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ওই কম্পনে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। এছাড়া বাস্তুচ্যুত হন ২০ লাখ মানুষ। পরবর্তীতে ২০১০ সালে ৮.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে দেশটিতে। ওই কম্পনে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত এবং ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়।

রাশিয়া : বিশ্বের প্রথম রেকর্ডকৃত ৯ মাত্রার ভূমিকম্পটি অনুভূত হয় রাশিয়ায়। ১৯৫২ সালে হাওয়াইতে কম্পনটি অনুভূত হলে এক বিশাল সুনামির সৃষ্টি হয়।

নেপাল : হিমালয়ের দেশ নেপালেও ঘন ঘন ভূমিকম্প আঘাত হানে। ২০১৫ সালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশটিতে ৮ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

হাইতি : ২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় হাইতিতে। ধসে পড়ে অনেক ঘরবাড়ি ও স্থাপনা।

মিয়ানমার : ২০২৫ সালের ২৮ মার্চে মিয়ানমারের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৭.৭ মাত্রার ওই কম্পনে নিহত হয় তিন হাজারের বেশি মানুষ।

বাংলাদেশ : বাংলাদেশে কখনও বড় ধরনের ভূমিকম্প বা ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় কম্পনের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ৩৬ ঘণ্টায় তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় এ ঝুঁকি আবারও উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। গত শুক্রবার নরসিংদীর মাধবদীতে ৫.৭ মাত্রার শক্তিশালী কম্পনে ১০ জন নিহত ও ৬০০-এর বেশি মানুষ আহত হওয়ার পর শনিবার সকালেই পলাশে ৩.৩ মাত্রার আফটারশক রেকর্ড করা হয় এবং সন্ধ্যায় ঢাকায় ৪.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। উৎপত্তিস্থল নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ইউএসজিএসের ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও ধারাবাহিক এসব কম্পন দেশের তীব্র ভূমিকম্পপ্রবণতা স্পষ্ট করে। জাতীয় মানচিত্র অনুযায়ী সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পার্বত্য অঞ্চলের বড় অংশ জোন-১ অর্থাৎ উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট লাইন- ডাউকি, মধুপুর, সিলেট-নোয়াখালী প্লেট বাউন্ডারি চাপ সঞ্চয় করছে। অতীত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারেই সবচেয়ে বেশি কম্পনের উৎপত্তি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত