গত একনেক সভায় চট্টগ্রাম ওয়াসার দুটি প্রকল্পের অনুমোদন চূড়ান্ত হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে নগরবাসীকে নির্বিঘ্নে সুপেয় পানি পৌঁছে ওয়াসার প্রকল্প দুটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৯২১ কোটি টাকা। জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে ওয়াসার দীর্ঘদিনের পুরনো পাইপ অপসারণ করে ৩০০ কিলোমিটার নতুন পাইপ প্রতিস্থাপন এবং ১ লাখ গ্রাহককে ডিজিটাল মিটারের আওতায় আনার একটি প্রকল্পসহ দুটি প্রকল্প সম্প্রতি একনেক সভায় অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম ওয়াসার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত ২০ এপ্রিল একনেক সভায় চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উঠে। প্রকল্প দুটি হল- চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ক্যাচমেন্টে-১ এর হালিশহর ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পে থাকছে নগরীতে ৩০০ কিমি পাইপ লাইন ও চট্টগ্রাম ওয়াসার ১ লাখ গ্রাহকের মাঝে ডিজিটাল মিটার স্থাপন। আগামী ২০ এপ্রিল একনেকের সভায় চট্টগ্রাম ওয়াসার দুটি প্রকল্প উঠার বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আনোয়ারা পাশা বলেন, চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের হালিশহরে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ব্যয় ও মেয়াদবৃদ্ধিকরণ প্রকল্পটি একনেকের সভায় উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২ এর অধীনে নগরীতে মোট ৮০০ কিলোমিটার পুরনো পাইপ তুলে নতুন পাইপ (ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইন) বসানো হয়েছিল। কিন্তু নগরীর পতেঙ্গা, খুলশী, একেখান, বায়েজিদ, অক্সিজেন, কালুরঘাট ও চাক্তাই এলাকায় পুরাতন জরাজীর্ণ পাইপ, লিকেজ, ম্যানুয়াল মিটারিং ব্যবস্থার কারণে বিদ্যামন ৪০ হাজার সার্ভিস কানেকশনে নিরবচ্ছিন্ন ও সুষম চাপে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। উক্ত এলাকা সমূহে সুষম চাপে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং পানির অপচয় রোধ করে রাজস্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে উক্ত এলাকা সমূহে ৩০০ কিলোমিটার নতুন পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন, ১ লাখ অটোমেটেড স্মার্ট মিটারিংসহ ডিএমএ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৩ হাজার ২৬৮ কোটি, সরকারি অর্থায়ন ৫৭৮ কোটি এবং ওয়াসার নিজস্ব ৭৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীতে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য এবং জলবায়ু সহনশীল পানি সরবরাহ বৃদ্ধি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নতকরণ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার পরিচালন দক্ষতা উন্নয়ন এবং আর্থিক ক্ষমতা টেকসইকরণ। প্রকল্পের অধীনে সবমিলে পয়োপাইপলাইন বসানো হবে ২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৮২ কিলোমিটার অগভীর পাইপলাইন। এসব পাইপলাইন সর্বনিম্ন ২ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৪ মিটার মাটির গভীরে বসানো হচ্ছে। অন্য ২০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো হচ্ছে সর্বনিম্ন ৭ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ১৪ মিটার মাটির গভীরে। প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে বিভিন্ন সাইজের সবমিলে পাইপলাইন বসানো হয়েছে ৯০ কিলোমিটার। এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ক্যাচমেন্টে-১ এর হালিশহর ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রকল্পটিও একনেকে উঠতে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীর হালিশহরে ওয়াসার ১৬৩ একর জায়গায় ওয়াসার আরও দুটি ক্যাচমেন্টের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম।
তিনি আরও জানান, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর ওয়াসার রাজস্ব, আর্থিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পানির উৎপাদন-এসব বিষয় একীভূত করে ওয়াসাকে একটা সিঙ্গেল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হবে। এতে ওয়াসার পরিচালন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা টেকসইকরণের পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে জবাবদিহিতা। বর্তমানে এই প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল থেকে ২০২৬ এর জুন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি ২০১৮ সালের নভেম্বরে অনুমোদন হলেও করোনার কারণে প্রায় দুই বছর কাজ শুরু করা যায়নি। চায়না এবং কোরিয়ান প্রকৌশলীসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা ওই সময় দেশে আসতে পারেননি। এই কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্প শেষ করার মেয়াদ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে আরও ৩৫ শতাংশ। তাই প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব সম্বলিত প্রথম সংশোধিত একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়। মূলত স্যানিটেশন অবকাঠামোর ডিজাইন টেকসইকরণজনিত ব্যয় বৃদ্ধি, স্থানীয় বাজারে পূর্ত কাজের ও আন্তর্জাতিক বাজারে মালামাল ও যন্ত্রপাতির দর বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয় করার লক্ষ্যে প্রকল্পটির সংশোধনী আনা হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য আজ ২০ এপ্রিল একনেক সভায় তোলা হচ্ছে। ওয়াসা সূত্র জানায়, দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদার সংস্থা তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজ করছে। প্রকল্পের অধীনে ২৮ হাজার গ্রাহককে পয়োসংযোগ প্রদান করা হবে। এরইমধ্যে ১০ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর নগরের ২০ লাখ মানুষ স্যুয়ারেজের আওতায় আসবে। সুয়ারেজের সংশোধিত প্রকল্পের ডিজাইন টেকসইকরণের মাধ্যমে এটির হালিশহরের ১৬৩ একর জায়গায় আরও দুটি স্যুয়ারেজের প্রকল্পের ক্যাচমেন্ট-৫ (উত্তর কাট্টলী) ও ৬-(পতেঙ্গা) ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট একই জায়গায় নিয়ে আসার সম্ভব হচ্ছে। তাতে ওয়াসার পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজতর হওয়া ছাড়াও আলোচ্য দুই প্রকল্পের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে সাশ্রয় হবে মোটা অংকের টাকা। পাশাপাশি উত্তর কাট্টলী ও পতেঙ্গা এলাকার মানুষ খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ওয়াসার স্যুয়ারেজের আওতায় আসবে। একনেকের অনুমোদন পেলে প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সালের জুনে শেষ করা হবে। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম ওয়াসার এটিই হচ্ছে প্রথম স্যুয়ারেজ প্রকল্প। পানির সরবরাহ ব্যবস্থাপনার পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম শহরকে ৬টি হাইড্রোলিক জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। জোনসমূহের মধ্যে একটি জোন ‘কর্ণফুলী সার্ভিস এরিয়া (কেএসএ)’ যা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। ‘কর্ণফুলী সার্ভিস এরিয়ায় (কেএসএ)’ জাইকা এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-২ প্রকল্পের আওতায় নগরে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার (সর্বনিম্ন ৪ ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ ৪৪ ইঞ্চি) পাইপলাইন প্রতিস্থাপন এবং ডিস্ট্রিক মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) ব্যবস্থা চালু করা হয়। তাতে এই এলাকায় প্রায় ৪৬ হাজার সার্ভিস কানেকশনে নিরবচ্ছিন্নভাবে সুষম চাপে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
এতে ওয়াসার ১০ শতাংশ সিস্টেম লস কমেছে। কেএসএ জোন ব্যতীত বাকি পাঁচটি সেক্টর পতেঙ্গা, খুলশী, একে খান, বায়েজিদ, অক্সিজেন, কালুরঘাট, চাক্তাই প্রভৃতি এলাকার পুরাতন জরাজীর্ণ পাইপলাইন, লিকেজ, ম্যানুয়াল মিটারিং ব্যবস্থা, অবৈধ সংযোগ প্রভৃতি কারণে বিদ্যমান ৪০ হাজার সার্ভিস কানেকশনে নিরবচ্ছিন্ন ও সুষম চাপে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন’ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব এলাকায় সিস্টেম লস ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। তাই এসব এলাকাসমূহে সুষম চাপে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং সিস্টেম লস কমিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইন প্রতিস্থাপন, অটোমেটেড স্মার্ট মিটারিংসহ ডিএমএ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। এছাড়া প্রকল্পটির অধীনে নগরের জন্য একটি পানি সরবরাহ মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হবে।