ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মহানবীর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা

আবদুল কাইয়ুম শেখ
মহানবীর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা

রাসুল (সা.) সব সময় সত্য বলতেন। সত্য বলা তার মজ্জাগত স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধকালের কোনো সময় তার মিথ্যা বলার নজির নেই। সত্য বলা তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি কীভাবেই বা মিথ্যা বলতে পারেন, অথচ সত্য নিয়ে ধরাপৃষ্ঠে তার আগমন? চির সত্য কোরআন দিয়ে মহান আল্লাহ তাকে ধরাধামে প্রেরণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যিনি সত্য নিয়ে আগমন করছেন ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন।’ (সুরা যুমার : ৩৩)।

মহানবী (সা.)-এর সত্যবাদিতা আপন-পর ও শত্রু-মিত্র সবার কাছে প্রবাদতুল্য ছিল। নবী হওয়ার আগেই কোরাইশের লোকেরা তাকে সত্যবাদী হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছিল। যেদিন মহানবী (সা.)-কে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম নির্দেশ দেওয়া হয়, সেদিন কোরাইশদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমি তোমাদের বলি, একটি শত্রুবাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে, তাহলে কি তোমরা আমার কথা সত্য বলে বিশ্বাস করবে?’ কোরাইশের লোকেরা বলেছিল, ‘অবশ্যই। আমরা আপনাকে কখনও মিথ্যা বলতে শুনিনি।’ এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যখন আপনি আপনার আত্মীয়-স্বজনকে ভয় প্রদর্শন করুন’ আয়াত অবতীর্ণ হলো, তখন রাসুল (সা.) সাফা পর্বতে আরোহণ করে আহ্বান জানালেন, হে বনি ফিহর! হে বনি আদি! এভাবে কোরাইশদের বিভিন্ন গোত্রকে ডাকলেন। অবশেষে তারা জমায়েত হলো। যে নিজে আসতে পারল না, সে তার প্রতিনিধি পাঠাল, যাতে দেখতে পায়, ব্যাপার কী? সেখানে আবু লাহাব ও কোরাইশরাও এলো। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘বল তো, আমি যদি তোমাদের বলি, শত্রু-সৈন্য উপত্যকায় চলে এসেছে, তারা তোমাদের ওপর হঠাৎ আক্রমণ করতে প্রস্তুত, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা আপনাকে সর্বদা সত্য পেয়েছি।’ (বোখারি : ৪৭৭০)।

ইসলাম গ্রহণ করার আগে আবু সুফিয়ান মহানবী (সা.)-এর প্রাণের শত্রু ছিলেন। তিনি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে নবীজি (সা.)-এর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য কোরাইশের প্রতিবাদের ভয়ে তিনি সত্য বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-কে সত্যবাদী বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আবু সুফিয়ান বলেছেন, স¤্রাট হিরাক্লিয়াস আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নবুওয়তের দাবিদার ব্যক্তির বর্তমানের কথাবার্তার আগে তোমরা তাকে কখনও মিথ্যাচারের অপবাদ দিয়েছ?’ আমি বললাম, ‘না।’ সম্রাট হিরাক্লিয়াস একপর্যায়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, এর আগে কখনও তোমরা তাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ? তুমি বলেছ, না! এতে বুঝলাম, এমনটি হতে পারে না যে, কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা পরিত্যাগ করবে আর আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে!’ (বোখারি : ৭)।

মহানবী (সা.) শুধু নিজে সত্যবাদী ছিলেন, তা নয়; বরং তিনি তার উম্মতের লোকদেরও সত্য বলার নির্দেশ দিতেন। তিনি এক বাণীতে সত্যকে ধারণ করা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সত্যকে ধারণ করা তোমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। কেননা, সততা সৎকর্মের দিকে পথপ্রদর্শন করে। আর সৎকর্ম জান্নাতের পথপ্রদর্শন করে। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে ও সত্য বলার চেষ্টায় রত থাকলে, অবশেষে আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।’ (মুসলিম : ৬৫৩৩)।

সত্যবাদী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহানবী (সা.) অত্যন্ত আমানতদার ও বিশ্বস্ত ছিলেন। সবচেয়ে বড় যে আমানত রাসুল (সা.) তার উম্মতের কাছে পৌঁছেছেন, তা হলো আল্লাহতায়ালা কর্তৃক অর্পিত রেসালাতের দায়িত্ব। তিনি রেসালাতের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধ ও বাণীসমূহ তার উম্মতের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। মহানবী (সা.) তার উম্মতের লোকদের কাছে আল্লাহতায়ালার বাণী কোনো ধরনের কমবেশি করা ছাড়া পৌঁছেছেন। বিদায় হজের দিন রাসুল (সা.) উপস্থিত সাহাবিদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহতায়ালার আমানত যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছি?’ তখন উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং রেসালাতের আমানত আমাদের কাছে কোনো ধরনের কমবেশি করা ছাড়া পৌঁছেছেন।’ আবু বকর (রা.) বলেন, কোরবানির দিন নবীজি (সা.) আমাদের খুতবা দিলেন ও বললেন, ‘তোমরা কি জান, আজ কোন দিন?’ আমরা বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে বেশি জানেন।’ নবীজি (সা.) নীরব হয়ে গেলেন। আমরা ধারণা করলাম, সম্ভবত মহানবী (সা.) এর নাম পাল্টে অন্য নামে নামকরণ করবেন। তিনি বললেন, ‘এটি কি কোরবানির দিন নয়?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘এটি কোন মাস?’ আমরা বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-ই সবচেয়ে বেশি জানেন।’ তিনি নীরব হয়ে গেলেন।

আমরা মনে করতে লাগলাম, হয়তো তিনি এর নাম পাল্টে অন্য নামে নামকরণ করবেন। তিনি বললেন, ‘এ কি জিলহজ মাস নয়?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘এটি কোন শহর?’ আমরা বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-ই সবচেয়ে বেশি জানেন।’ রাসুল (সা.) নীরব হয়ে গেলেন। আমরা ভাবতে লাগলাম, হয়তো তিনি এর নাম বদলে অন্য নামে নামকরণ করবেন। তিনি বললেন, ‘এ কি সম্মানিত শহর নয়?’ আমরা বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমাদের জান-মাল তোমাদের জন্য তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত এমন সম্মানিত, যেমন সম্মান রয়েছে তোমাদের এ দিনের, তোমাদের এ মাসের এবং তোমাদের এ শহরের।’ মহানবী (সা.) সাহাবিদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি কি আল্লাহর আমানত তোমাদের কাছে পৌঁছেছি?’ সাহাবিরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে (আমার দাওয়াত) পৌঁছে দেয়। কেননা, যাদের কাছে পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অনেক ব্যক্তি এমন থাকে যে, শ্রবণকারীর চেয়ে অধিক সংরক্ষণকারী। তোমরা আমার পরে একে অপরকে হত্যা করে কুফরির দিকে যেও না।’ (বোখারি : ১৭৪১)।

নবী হওয়ার আগেই মক্কার লোকেরা রাসুল (সা.)-কে একবাক্যে আমানতদার ও বিশ্বস্ত বলে স্বীকার করত। তারা ব্যক্তিগত বিভিন্ন গোপন বিষয় ও জিনিসপত্র রাসুল (সা.)-এর কাছে আমানত রাখত। রাসুল (সা.) নবুওয়ত লাভ করার আগেই মক্কার অধিবাসীরা তাকে আল আমিন (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। খাদিজা (রা.) নিজের ব্যবসার দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর কাঁধে অর্পণ করেছিলেন তার আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার কারণে। বিশ্বনবি (সা.)-এর বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে খাদিজা (রা.) একপর্যায়ে স্বেচ্ছায় মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব করেন। বিশ্বনবী (সা.) প্রস্তাব মঞ্জুর করলে তিনি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন।

আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার ওপর মহানবী (সা.) অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করতেন। যেদিন আল্লাহতায়ালার আদেশে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার ইচ্ছা করেন, সেদিন বহু কাফের হত্যা করার জন্য তার ঘর পরিবেষ্টন করে নেয়। এদিন কাফেররা নবীজি (সা.)-কে হত্যা করার দৃঢ় সংকল্প করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসুল (সা.)-এর কাছে লোকদের যেসব বস্তু আমানত ছিল, সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আলী (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তুমি এগুলো মালিকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে।’ সন্দেহ নেই, যেসব লোক হত্যা করার জন্য তার আবাস ঘিরে রেখেছিল, তাদের মধ্যে আমানতকারীরাও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসুল (সা.) তাদের আমানতের খেয়ানত করেননি। নিজের প্রাণ সংহার করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সঙ্গেও বিশ্বস্ততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। কেননা, আমানতদারি ও বিশ্বস্ততা পূর্ণাঙ্গ ঈমানদারির পরিচায়ক। যদি কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো বস্তু আমানত রাখা হয়, এরপর সে আমানতকারীকে যথাসময়ে সেই বস্তু ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে আমানত গ্রহণকারীর ঈমান ত্রুটিপূর্ণ বলে গণ্য হয়। এমন ব্যক্তির ঈমান অপূর্ণাঙ্গ থাকার ইঙ্গিত রাসুল (সা.) এক বাণীতে প্রদান করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরূপ ভাষণ খুব কমই দিয়েছেন, যাতে বলেননি, ‘যার আমানতদারি নেই, তার ঈমানও নেই এবং যার অঙ্গীকার পূরণ নেই, তার দ্বীনও নেই।’ (বায়হাকি : ৪০৪৫)।

আমানত আদায় করা মহানবী (সা.)-এর অন্যতম মহোত্তম চারিত্রিক গুণ ছিল। তিনি নিজে আমানত আদায় করতেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকদেরও আমানত আদায় করার নির্দেশ দিতেন। ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার সময় কাফের লোকদেরও আমানত আদায় করার নির্দেশ দিতেন। মুসলমান হওয়ার আগে আবু সুফিয়ান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আবু সুফিয়ান (রা.) আমাকে খবর দিয়েছেন, হিরাক্লিয়াস তাকে বলেছিলেন, তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি তোমাদের কী কী আদেশ করেন? তুমি বললে যে, তিনি তোমাদের নামাজের, সত্যবাদিতার, পবিত্রতার, ওয়াদা পূরণের ও আমানত আদায়ের আদেশ দেন। হিরাক্লিয়াস বললেন, ‘এটাই নবীদের গুণ।’ (বোখারি : ২৬৮১)। মহানবী (সা.) কর্তৃক আমানত আদায়ের আদেশ দান সম্পর্কে অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, উম্মে সালামা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন সত্য কথা বলি, আমানত আদায় করি, আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখি এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করি। (সহিহ ইবনে খোযায়মা : ২২৬০)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত