ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুরা রহমানে বর্ণিত নেয়ামতগুলো

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
সুরা রহমানে বর্ণিত নেয়ামতগুলো

মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন, এর সবকিছুই এই জগতের পরতে পরতে বিছিয়ে রেখেছেন আল্লাহ। কিন্তু মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ জীব। যে মহান রব এত এত নেয়ামতে সিক্ত করলেন, মানুষ সে রবেরই বিরুদ্ধাচারণ করে। তাই রব্বুল আলামিন সুরা রহমানে জানতে চান, ‘তোমরা উভয়ে কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’

এখানে ‘উভয়ে’ বলতে মানুষ ও জিনকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, এই দুই জাতির কল্যাণার্থেই আল্লাহতায়ালা আলো-ছায়া, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝরনাধারা ও নির্মল বাতাস যেমন সৃজন করেছেন। তেমনি ফুল-ফসলপত্র পল্লবে প্রকৃতিকে করেছেন নয়নাভিরাম। আর সুপথে চলার জন্য দিয়েছেন পবিত্র কোরআন। তাঁর এই অগণিত নেয়ামতের কিঞ্চিৎ তুলে ধরা হয়েছে সুরা রহমানে। এরশাদ হয়েছে, ‘পরম করুণাময়। তিনি শিখিয়েছেন কোরআন।’ (সুরা রহমান : ১-২)।

আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে মানুষকে কোরআন শিখিয়েছেন। জীবনে চলার পথে ছোট-বড় সব সমস্যার সমাধান যেমন এই কোরআন থেকে সহজেই পাওয়া যায়। তেমনি পৃথিবীর মহাবিশ্বের নানা রহস্য উন্মোচনে আহরণ করা যায় তথ্য-উপাত্ত। কোরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, এ যেন এক মহা বিজ্ঞানও। আল্লাহতায়ালা এই রত্নভাণ্ডার আমাদের হাতের মুঠোয় দিয়ে বলেন, ‘আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্য। অতএব, কোনো চিন্তাশীল আছে কি?’ (সুরা কামার : ১৭)।

আল্লাহতায়ালা কোরআন যেমন শিখিয়েছেন, তেমনি শিখিয়েছেন ভাষা। মানবজীবনকে পূর্ণতা দান ও শ্রেষ্ঠ জাতিতে উন্নিত করার জন্য ভাষার বিকল্প নেই। যার মুখে ভাষা নেই, সেই শুধু ভাষার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্দ করতে পারে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে জীবন্ত ভাষা আছে ৬ হাজারেরও অধিক। পৃথিবীতে এই যে অসংখ্য ভাষা, এই অসংখ্যা ভাষার উচ্চারণগত ভিন্নতাও অসংখ্য রকমের। বৈচিত্র্যময় এ ভাষা মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করে।

কোরআন ও ভাষার মতো এমন বিস্মিত নেয়ামত পেয়েও যারা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। তার একাত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে না, সেই অবিশ্বাসীদের চারপাশের নেয়ামতরাজির প্রতি ঈঙ্গিত করেন মহান আল্লাহ জানতে চান, এই নেয়ামতগুলো তাদের কে দিয়েছেন?

আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জিনের প্রয়োজনেই চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। যেন এর দ্বারা তারা দিবসে নিজেদের কাজ-কর্ম সহজ ও নির্বিঘ্নে করতে পারে। ভাবুন তো, যদি না থাকত এই রূপালী চাঁদটা, তাহলে আমাদের চারপাশের পরিবেশ কেমন হতো? ২৪ ঘণ্টার দিন শেষ হয়ে যেত মাত্র ৬ ঘণ্টায়। সমুদ্রে থাকত না জোয়ার-ভাটা। জমিতে ফলত না সোনার ফসল। আল্লাহতায়ালা আরও নানা প্রয়োজনে এই চাঁদ ও সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘মহিমাময় সেই রব, যিনি আকাশে সূর্য বানিয়েছেন এবং তাতে এক উজ্জ্বল প্রদীপ ও আলোকিত চাঁদ সৃষ্টি করেছেন সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়।’ (সুরা ফুরকান : ২৫-৬১)।

আবার রাতের অন্ধকারে মানুষ যেন পথ না ভুলে, তার জন্য আকাশে বসালেন তারার মেলা। মানুষ অন্তত এই সুদৃশ্য আকাশ দেখে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করতে পারত। কিন্তু তা না করে উল্টো এই চন্দ্র-সূর্য, তারকারাজিকে ‘রব’ বলে ডাকতে শুরু করল। সুরা রহমানে আল্লাহতায়ালা তাঁর আরেক নেয়ামত ‘আকাশ’ এর কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, ‘আর তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করেছেন।’ (সুরা রহমান : ৭)।

মহান আল্লাহর অজস্র সৃষ্টিকর্মের মধ্যে এক রহস্যময় সৃষ্টির নাম হলো আকাশ। বিশাল এই আকাশের নান্দনিকতা, নিপুনতা, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে মনের পর্দায় ভেসে উঠে আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতের অসংখ্যা নির্দশন। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি নির্মাণ করেছি তোমাদের উপর মজবুত সপ্ত আকাশ।’ (সুরা নাবা : ১২)।

সুরা রহমানে আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের মতো নেয়ামতের বর্ণনা যেমন দিয়েছেন, তেমনি জমিন, গাছপালা, সুগন্ধি ফুল, ফলমূল ও খোসাযুক্ত খেজুরের কথা বলেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টিজীবের জন্য। তাতে রয়েছে ফলমূল ও খেজুরগাছ। যার খেজুর আবরণযুক্ত। আর আছে খোসাযুক্ত দানা ও সুগন্ধিযুক্ত ফুল।’ (সুরা রহমান : ১১-১৩)।

আল্লাহর অনন্য নেয়ামতের মধ্যে সাগর অন্যতম এক নেয়ামতের নাম। সাগর যেন এক রহস্যপুরী। এ রহস্যপুরীর তলদেশে তলদেশে রক্ষিত গ্যাস, কয়লা, মনোমুগ্ধকর প্রবাল সৌন্দর্য ও মণি-মুক্তার কথাও উল্লেখ করা হয়ে সুর রহমানে। তিনি বলেছেন, ‘উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণি-মুক্তা ও প্রবাল।’ (সুরা রহমান : ২২)।

সাগরের আরেক রহস্য তুলে ধরা হয়েছে এই সুরায়। এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যারা পরস্পর মিলিত হয়। উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক আড়াল। যা তারা অতিক্রম করতে পারে না।’ (সুরা রহমান : ১৯-২০)

সুরা রহমানে আল্লাহতায়ালা পাহাড়সম জাহাজের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘সমুদ্রে বিচরণশীল পর্বতসম জাহাজগুলো তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন।’ (সুরা রহমান : ২৪)।

এর অর্থ হলো, বিশাল এই জাহাজগুলো তাঁরই অপার দয়ায় ভেসে থাকে। যেন মানুষ তাঁর সামানা নিরাপদে সহজে কাঙ্খিত মঞ্জিলে নিয়ে যেতে পারে। জান্নাতের অনুপম সৌন্দর্যের চিত্রও তুলে ধরেছেন। যেখানে ‘তাসনিম’ ও ‘সালসাবিল নামের দুটি ঝরনাধারা থাকবে। দুই ঝরনার চারপাশে চমৎকার ও সুস্বাদু ফুল ফলের বৃক্ষ থাকবে। যেখানে জান্নাতিরা রেশমের বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে, তাদের নাগালেই ঝুলবে জান্নাতি ফল। আর থাকবে তিলোত্তমা হুর। যে মহান আল্লাহ আমাদের এতসব নাজনেয়ামতে সিক্ত করলেন, আমরা কী করে তাঁর অশুকরিয়া করি। অবাধ্য হই। লঙ্ঘন করি পবিত্র বিধান। আমাদের উচিত, এখনই তওবা করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা। তাঁর অগণিত নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। তাহলে আল্লাহতায়ালা নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা আমার নিয়ামতপ্রাপ্তির শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে তোমাদের নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেওয়া হবে, আর অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন আজাবে (শাস্তিতে) নিপতিত করা হবে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।

সুরা রহমান,ফযিলত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত