তখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ। মুসলমানরা তৎকালীন ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) হিজরত করেন। পেছনে রেখে যান পবিত্র কাবাঘর। জন্মের আলয়। পরিচিত শহর। আত্মার আত্মীয়। বন্ধু-বান্ধব। বেড়ে ওঠার মাঠ, পথ-ঘাট।
মুসলমানদের সামনে তখন হিজরত ভিন্ন কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অনুসারীদের পাঠিয়ে দেন মদিনায়। বেলাল (রা.) ও চললেন মদিনার পথে। মদিনায় তিনি স্বাধীন মানুষ। নিজেকে দুনিয়ার সব ঝামেলা থেকে মুক্ত করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য প্রস্তুত করলেন। তার খাদেম হলেন। তার সঙ্গে প্রয়োজনে শহরের বাইরে যেতেন। একসঙ্গে বাড়ি ফিরতেন। নবীজির অনুকরণে নামাজ পড়তেন। যুদ্ধে নবীজির সহযোদ্ধা হতেন। নবীজির সঙ্গে একাকার করে দিলেন নিজেকে। যেন বেলালের জন্মই নবীজির জন্য। এভাবে বেলাল হয়ে উঠলেন নবীজির নিত্যসঙ্গী, কাছের মানুষ।
সে সময় ইসলামের জোয়ার এলো। লোকেরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে লাগল। মসজিদের প্রয়োজন দেখা দিল। মসজিদ নির্মিত হলো। আজানের প্রয়োজন পড়ল। আজান এলো। বেলাল (রা.) হলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। বেলাল (রা.) মসজিদে নববির নিয়মিত মুয়াজ্জিন। পাঁচবেলা সময় করে আজান দেন। ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলে মিম্বারের দিকে তাকান। রাসুল (সা.)-কে দেখেন। মুচকি হাসেন। বড় মধুর সুরে প্রিয় এই শব্দ উচ্চারণ করেন তিনি। রাসুল (সা.) কখনও ঘর থেকে বেলালের আজানের পবিত্র ধ্বনি শোনেন। রাসুল (সা.) ঘর থেকে আজান শুনছেন- এ ভাবনা বেলালকে প্রাণবন্ত করে তুলত।
এক দিন প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়- স্বপ্নের মক্কা বিজয় হয়। মুসলমানরা বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। কাবাঘরের মূর্তি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন নবীজি ও তার সঙ্গে আরও তিনজন। একজন বেলাল (রা.), কাবাঘরের চাবি বহনকারী উসমান ইবনে তালহা (রা.) ও তার প্রিয়পাত্র উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)।
রাসুলুল্লাহ (রা.) কাবাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাজারো মানুষ তার চারপাশে। মুসলমানদের চোখে-মুখে সুখের আভা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মক্কা ছেড়ে যাওয়া মুহাজিররা আপন ভুবনে বীর বেশে ফিরতে পেরে খুশিতে অস্থির। এর মধ্যে জোহরের সময় ঘনিয়ে এলো। মুহাম্মদ (সা.) বেলাল (রা.)-কে ডেকে পাঠালেন। বললেন, কাবার ছাদে উঠে আজান দাও। বেলাল (রা.) দাঁড়িয়ে থাকেন। অপলক তাকিয়ে থাকেন প্রিয়নবীর মুখের দিকে। অস্থির আনন্দে কেঁদে উঠেন। আহ্, সেদিনের মক্কার কৃতদাস আজ কাবাঘরের ছাদে উঠে আজান দেবে। সে দিনের রাখাল, ঘরের চাকর, হাবশি দাস! আহ, বেলাল! যেই কাবা ঘরে একদিন স্পর্শ করা ছিল স্বপ্নের ব্যাপার।
প্রিয়নবীজি (সা.) এক দিন পরপারে চলে গেলেন। রাসুলের মৃত্যু সংবাদে মদিনাজুড়ে নেমে এলো শোক ও নিস্তব্ধতা। যেন কোথাও কেউ নেই। সবই আছে, যেন কী নেই! জীবন আছে কিন্তু জীবনের গতি নেই। প্রাণ আছে; কিন্তু সেটা মৃত। সাহাবিরা তুমুল ভেঙে পড়লেন। তাদের হৃদয়াত্মা হাহাকারে বিদীর্ণ। রাসুলের মৃত্যুর কথা শুনে বেলাল (রা.) শিশুর মতো কাঁদছেন। চোখের পানিতে গাল জামা ভিজে একাকার হয়ে আছে। বাবা হারানো বাচ্চার মতো এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন। স্মৃতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অন্তর। মনবন্দরে ভিড় করছে বেদনার সাতকাহন।
যন্ত্রণার পৃথিবীতে মাথার ওপর সূর্য নামে। সূর্যের রং বিবর্ণ হয়। আকাশ ধূসর রঙে ছেয়ে ওঠে। এর মধ্যে নামাজের সময় হয়। আবু বকর (রা.) বেলালকে আজান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বেলাল না করেন। আবু বকর বোঝাতে চেষ্টা করেন। বেলাল নাছোড়বান্দা। তিনি বেলালের হাত ধরেন। বেলাল বলেন, ‘আমি কার জন্য আজান দেব। কে শুনবে আমার আজান? ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ বলে কার দিকে তাকাব? আমার প্রিয় তো নেই। কে আমার আজানের ধ্বনি শুনে ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে আসবেন! কে অধীর থাকবে হাবশি গোলামের আজানের জন্য।
বেলাল (রা.) ভাবেন, আবু বকর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় মানুষ। তার অনুরোধ অমান্য করা ভারি অন্যায়। দাঁড়িয়ে যান আজানের জায়গায়। বেলালের ব্যথিত কণ্ঠে আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যখন বলতে গেলেন, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ কান্নার বিরহী আওয়াজ কণ্ঠরোধ করে দেয়। আজান আটকে যায় কণ্ঠে। বেলাল হাউমাউ করে উঠেন। সাহাবিরাও ভেঙে পড়েন কান্নায়। কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে মসজিদে নববির আবহ। এই শব্দ বলতে গেলেই তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।
বেলালের (রা.) কাছে এই শহরের আর কোনো মূল্য নেই। যে শহরে প্রিয় রাসুল নেই, সে শহরে বেলালের কী দরকার! এই শহরে বেলালের আর কেউ বেঁচে নেই। আজানের ধ্বনি যদি তিনিই না শোনেন, আর কেন বাজবে এ কণ্ঠে আজানের ধ্বনি! এই মসজিদ, এই চত্বর, এই আসহাবে সুফফা তাকে টানে না। রাসুলবিহীন এই শহর তিনি ছেড়ে দেবেন- অনুমতির জন্য আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কাছে গেলেন। অনুমোদন দিতে দ্বিধা করছেন আবু বকর। বললেন, বেলাল, আপনার মতো লোক এই শহরের রহমত। আপনাকে ছাড়া আমরা আরও এতিম হয়ে যাব।’ বেলাল বললেন, ‘আপনি আমাকে ক্রয় করেছিলেন, সেটা যদি নিজের জন্য করে থাকেন তাহলে আমাকে আটকে রাখুন। আর আল্লাহর জন্য করে থাকলে ছেড়ে দেন।’
‘আমি আল্লাহর জন্য আপনাকে ক্রয় করেছিলাম।’ ‘আল্লাহর রাসুলের আদেশে আমি আজান দিতাম। তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আমি কী করে আজান দিই।’
বেলাল (রা.) রাসুলের বিদায়ের কষ্ট সইতে না পেরে মদিনা ছাড়লেন। সিরিয়ার হালবে থাকা শুরু করলেন। তিনি আজান দেয়া বন্ধ করে দিলেন। এভাবে এক বছর কেটে গেল। এক দিন স্বপ্নে রাসুল (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভ করলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘বেলাল, তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ছেড়ে দিয়েছ কেন? তোমার হৃদয় কি আমার সাক্ষাৎ পেতে চায় না?’ বেলাল ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। অস্থির হয়ে বিছানা ছাড়লেন। রাতের আঁধারে উটের পিঠে চড়ে রওনা করলেন মদিনা পানে। চোখে স্বপ্নের ছবি। মনে পুরোনো স্মৃতির শিবির। রাতদিন সফর শেষে পৌঁছলেন কাঙ্ক্ষিত সেই মদিনায়। সোজা গেলেন মসজিদে নববিতে। নবী নেই! গেলেন হুজরায়। সেখানেও নেই। এদিক-সেদিক খুঁজলেন। প্রিয় নবীজি কোথাও নেই। অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত রাসুলের রওজার পাশে হাজির হলেন। তার চোখের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা ঝরে পড়ছে গালে, শরীরে এবং রাসুলের রওজার পবিত্র মাটিতে।
এরই মধ্যে বেলালের আগমন সংবাদ মদিনায় চাউর হয়ে যায়। লোকেরা মসজিদে নববিতে ভিড় করছে। নবীজির মুয়াজ্জিন বেলাল এসেছে! নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে। মানুষ তাকে আজানের জন্য অনুরোধ করে বললেন, ‘একটিবার সেই আজান দিন, বেলাল। কত দিন আপনার কণ্ঠে আজান শুনি না।’ বললেন, এটা আমার সাধ্যের বাইরে। যে শহরে রাসুল নেই, সে শহরে আমি বেলাল আজান দিতে পারি না।’ কেউ গিয়ে হাসান-হুসাইনকে খবর পাঠালেন। তারা নানাজানের বন্ধুকে দেখতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বেলালকে জড়িয়ে ধরলেন। অনুরোধ করলেন, সেই আজান শোনানোর জন্য, যেই আজান নবীজিকে শোনাতেন। হাসান-হুসাইনকে না করতে পারলেন না। এ যে রাসুলের রক্ত। বেলাল আজানের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’। বেলালের আজানের শব্দ মদিনার বাতাসে সুর মেলে ধরল। মদিনাবাসীর হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠল। শহরে সাড়া পড়ে গেল। পুরো শহর যেন নড়েচড়ে উঠল। পরস্পরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। আমাদের প্রিয় রাসুল কী এসে পড়েছেন মদিনায়! রাসুলের সময়ের আজান দিচ্ছে কে? এই আজান তো আমরা রাসুলের সময়ে শুনতাম। সেই পুরোনো দিনের আবহ যেন খেলা করছে মদিনাজুড়ে। কোনো সাহাবি হুজরার পথে তাকিয়ে আছেন। এই আজান শুনেই তো আল্লাহর নবী এ পথ ধরে মসজিদে আসতেন। আহ, আজ বেলাল আজান দিচ্ছে, কিন্তু রাসুল নেই। বেলাল ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ বলতে গিয়ে আটকে গেলেন। মিম্বারে রাসুল নেই। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না। বেহুঁশ পড়ে রইলেন।
বেলাল (রা.) আবার সিরিয়ায় চললেন। বিরলে, নির্জনে, মনের দুঃখ মনে নিয়ে। স্মৃতির ঘর থেকে মুছে ফেললেন এই শহরের স্মৃতি। আর কোনো দিন এই শহর অভিমুখী হননি।
বেলাল (রা.) তখন দামেস্ক অঞ্চলে বসবাস করছিলেন। তিনি ভীষণ অসুস্থ। বলা যায় মৃত্যুশয্যায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আর বাঁচবেন না। স্ত্রী আহাজারি করতে করতে বললেন, ‘আহারে, আজ কতই না কষ্টের দিন।’ তিনি চোখে মেলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহ্ কত আনন্দ! বরং বলো, আজ আনন্দের দিন। কাল আমি আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবাদের সঙ্গে মিলিত হব।’