ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

হজের দিনে যেসব আমল করা জরুরি

শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মাদ আল কাসিম
হজের দিনে যেসব আমল করা জরুরি

শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। মহান আল্লাহ এই দিনগুলোর মর্যাদা বাড়িয়েছেন, এর গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছেন, এমনকি এর শপথও করেছেন। আল্লাহ শুধু মহামূল্যবান বিষয়েরই শপথ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘শপথ ঊষার, আর শপথ দশ রজনীর।’ (সুরা ফজর : ১-২)। এই দিনগুলো সম্মানিত মাসগুলোর অন্তর্ভুক্ত ও জ্ঞাত মাসসমূহের শেষাংশ।

এই দিনগুলো রমজানের শেষ দশকের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। ইসলামের বিখ্যাত পণ্ডিত আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘জিলহজের প্রথম দশদিন, রমজানের শেষ দশ দিনের চেয়েও উত্তম। তবে, রমজানের শেষ দশ রাত, জিলহজের রাতগুলোর চেয়ে উত্তম।’ এই দিনগুলোতে কৃত সৎকর্ম আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়। তারা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি উত্তম নয়? নবীজি (সা.) বললেন, জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (বোখারি : ৯৬৯)। এই ১০ দিনে সমস্ত প্রধান ইবাদত একত্র হয়েছে। যেমন- নামাজ, সদকা, রোজা, হজ ও কোরবানি। এই দিনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো হজ, যা আল্লাহর ঘর কাবার হজ করা। এটি ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোর একটি। এই ইবাদতের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ আগের সমস্ত গুনাহ মুছে দেয়।’ (মুসলিম : ২২০)।

হজ হাজীকে পাপ থেকে পবিত্র করে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে বাইতুল্লাহর হজ আদায় করল, অশ্লীলতায় জড়িত হলো না ও আল্লাহর অবাধ্যতা করল না, সে যেন মায়ের পেট থেকে সদ্য প্রসূত শিশুর মতো প্রত্যাবর্তন করল।’ (বোখারি : ১৮২০)।

এই দশ দিনের মধ্যে আছে আরাফার দিন, যা মুসলমানদের এক মহাসম্মিলনের দিন। এই দিনটি মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও বরকতময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আরাফার দিনের রোজা আগের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করিয়ে দেয়।’ (মুসলিম : ২৬৩৬। এই দিনটি দোয়া, আশা, বিনয় ও আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের দিন। আল্লামা ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের দোয়া অধিকাংশ সময়েই কবুল হয়।’

এই দশ দিনের মধ্যেই মুসলমানদের ঈদুল আজহা বা কোরবানির দিন রয়েছে। এটি হলো আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন, সবচেয়ে সম্মানিত দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজে ঈদের দিন ভাষণ দেওয়ার সময় বলেন, ‘জেনে রাখো, এই দিনটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন।’ (মুসনাদে আহমদ)। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফা দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আল্লাহতায়ালা সর্বাধিক লোককে দোজখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। সেদিন আল্লাহ নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের সামনে গৌরব করে বলেন, ‘তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে বা তারা কী চায়?’ (মুসলিম : ৩১৭৯)

এই দিনটি হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রকাশ্য দিন। হজের বড় বড় কাজগুলো এই দিনে করা হয়। এটিকেই বলা হয় ‘হজে আকবর’- বড় হজের দিন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মহান হজের দিবসে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয়ই মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসুলও।’ (সুরা তওবা : ৩)।

এই দিনেই আল্লাহ এ উম্মতের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। আজও মুসলমানদের মনে এই দিনের কথা আবর্তিত হয়, তাদের হৃদয়ে আছে আল্লাহর ঘরের হজের জন্য গভীর টান। আর আল্লাহর করুণা এই যে, তিনি হজ শুধু তাদের ওপর ফরজ করেছেন, যারা সামর্থ্য রাখে। যে হজ করার ইচ্ছা করে; কিন্তু সামর্থ্য পায় না- আল্লাহ তাকে হজের সওয়াব দিয়ে দেন। এই ১০ দিনে বেশি করে আল্লাহর জিকির সুন্নত। আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় জায়গাগুলোতে উপস্থিত হতে পারে ও নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ (সুরা হজ : ২৮)। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ ও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলো।’ (মুসনাদে আহমদ)।

এই সময়ে ‘তাকবির’ বলা ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। তাকবির বলা হয় দুইভাবে- এক. সাধারণ তাকবির- যেকোনো সময় বলা যায়। দুই. নির্দিষ্ট (নামাজ-পরবর্তী) তাকবির। আরাফার দিন ফজরের নামাজ থেকে শুরু করে ১৩ জিলহজ আসরের নামাজ পর্যন্ত, প্রতিটি ফরজ নামাজের পর তাকবির বলা সুন্নত- হজযাত্রী এবং অন্যদের জন্যও।

এই সময়ে কোরআন তেলাওয়াতে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। সদকা করা বড় ফজিলতের কাজ।

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত, যা আল্লাহ নামাজের সঙ্গে একত্রে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে কাউসার দান করেছি।’ (সুরা কাউসার : ২)। আল্লাহ আমাদের কোরবানির গোশত বা রক্ত চান না; বরং চান আমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ : ৩৭)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে দুটি সাদা ও শিংওয়ালা খাসি কোরবানি করেছেন। সবচেয়ে ভালো কোরবানি হলো- যে পশু দামে বেশি ও পরিবারের কাছে প্রিয়। আল্লাহর বড় দয়া হলো, তিনি জিলহজের এই বরকতময় মৌসুম এমনভাবে বানিয়েছেন, যাতে হজে যাওয়া ও যেতে না পারা- দু’দলই সওয়াব পেতে পারে। হজ শুধু সময়ের ফজিলত নয়; বরং স্থানেও ফজিলতের সঙ্গে যুক্ত। মক্কা আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় শহর, যাকে তিনি পবিত্র করেছেন, সেখানে নিরাপত্তা দিয়েছেন ও অনেক বরকত রেখেছেন। এই শহরে যুদ্ধ করা নিষেধ, পাখিকে ভয় দেখানো নিষেধ, গাছকাটা নিষেধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার মক্কার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি আল্লাহর সবচেয়ে উত্তম ভূমি এবং আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ভূমি।’ (মুসনাদে আহমদ)। সফল হজযাত্রী সেই ব্যক্তি, যে সময়টাকে ইবাদতে কাটায়, সৎকর্মে নিজের পাথেয় সংগ্রহ করে, আল্লাহর রহমতের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে, নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করে, আর হজ ও উমরার সেবাকারীদের জন্য দোয়া করে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমাদের আমি যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে আহার করো ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো; যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)।

মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এই যাত্রার বিরতি শুধু দুই জায়গায়- জান্নাত অথবা জাহান্নাম। জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত যদি কাউকে আল্লাহর কাছে নিয়ে না যায়, তবে সে নিশ্চয়ই আরও দূরে চলে যায়। তাই আসুন, ইবাদতের মৌসুম চলে যাওয়ার আগেই কাজে লাগাই ও পাপ থেকে বিরত থাকি। কেননা, আল্লাহ পাপ সহ্য করতে পারেন না। ?আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আর আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ হলো, যেন কোনো মুমিন বান্দা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।’ (বোখারি : ৫২২৩)।

পবিত্র মাসগুলোতে গোনাহ আরও ভয়াবহ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস বারোটি; এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’ (সুরা তওবা : ৩৬)।

যখন কেউ আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলোতে তওবা করে, তখন সেই তওবা কত সুন্দর! যে অনুভব করে যে তার কথায়, কাজে, অবস্থা বা রিজিকে ঘাটতি চলছে, অথবা হৃদয় অস্থিরতায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তার উচিত আল্লাহর একত্ববাদে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং আন্তরিকভাবে তওবা ও ইসতেগফার করা।

(০৩-১২-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ৩০-০৫-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত