ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শন

ড. আকম আবদুল কাদের
মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শন

ছয়. পবিত্র হজ পালন উপলক্ষে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পদস্থ কর্মকর্তা ও মুসলিম কমিউনিটির লিডাররা পবিত্র মক্কা নগীতে সমবেত হন। আর সুনির্দিষ্ট দিনগুলোতে হজের বিধি-বিধান পালনের লক্ষ্যে তারা পবিত্র স্থানসমূহে অবস্থান করেন। মুসলিম রাষ্ট্র সংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময়ে মুসলিম উম্মাহর সংকট বিষয়ে মহাসম্মেলনের আয়োজন করা যেতে পারে। এতে কোনো রাষ্ট্রের কোনো ধরনের আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে না। অথচ মুসলিম উম্মাহর আগামী দিনের চলার পথের ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনার ঘোষণা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজতর হবে। আর এর মাধ্যমে প্রতিটি দেশ আন্তঃসহযোগিতার এক অপূর্ব সুযোগ লাভ করবে।

সাত. মুসলিম উম্মাহ বর্তমানে তথ্য সন্ত্রাসের শিকার। আর এটি আধুনিক মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ। হজ ইসলামের সুমহান বাণী বিশ্বব্যাপী প্রচারের অন্যতম মাধ্যম। আরাফাতের খুতবা সাধারণত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এইভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং ইসলাম সম্পর্কে অপপ্রচার ও ভুল তথ্য উপস্থাপন বন্ধে মুসলিম উম্মাহ বিশ্বের প্রতিনিধিত্বশীল ভাষায় শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

আট. কোরআন নাজিল হয়েছে মক্কা ও মদিনায়। হজ উপলক্ষে আগত হাজীরা সাধারণত হজের দিনগুলো ছাড়া কিছুদিন এই দুই নগরীতে অবস্থান করে থাকেন। বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম দেশে কোরআন বিবর্জিত রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন প্রচলিত রয়েছে। অথচ কোরআন অবিকৃত গ্রন্থ হিসেবে আমাদের কাছে বিদ্যমান। মুসলিম বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের আইনের উৎস হিসেবে কোরআনকে গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ রাসুল (সা.) ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র নেয়ামক শক্তি হিসেবে কোরআনের চর্চা ও অনুশীলনের তাগিদ দিয়েছেন।

নয়. মুসলিম বিশ্ব আজ অনৈক্যের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। এই বিভক্তি বিশ্বের বুকে তাদের শৌর্য-বীর্যকে ম্লান করে দিয়েছে। ‘একতাই শক্তি’ এই স্লোগানবিস্মৃত মুসলিম জনপদ শুধু দেশে দেশে এবং জাতিতে জাতিতে বিভ্রক্ত হয়নি, আকিদা এবং মানহাজেও তাদের মধ্যকার অনৈক্য প্রকট। অথচ হজের শিক্ষা ও দর্শন সকল মত ও সকল মানহাজের লোকদের একই মোহনায় মিলিত করে। এই মিলনকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দানের ক্ষেত্রে হজের শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

দশ. হজ বিত্ত-বৈভবের অহংকার ভুলে সবাইকে এক কাতারে শামিল করে। কী রাজা, কী প্রজা, কী প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক, সকলের দেহে একই পোশাক, সকলের পায়ে একই স্যান্ডেল, দীনহীন বেশে সবাই কখনও তাঁবুতে, কখনও উন্মুক্ত প্রান্তরে কখনও বায়তুল্লাহর চত্বরে, আবার কখনও সাফা পর্বত থেকে মারওয়া অভিমুখে, কখনো জামারাতে এভাবে তাদের পরিভ্রমণ। এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে বিদ্যমান অহংবোধ দূর হয় এবং আমিত্বের মনোবৃত্তি তিরোহিত হয়। ফলে একে অপরের আনন্দে উদ্বেলিত হয়, আবার একে অপরের দুঃখে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেয়।

এগারো. হজের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। পশু শুধু একটি প্রাণী নয়। এর মাধ্যমে হাজীরা জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়ার গলায় ছুরি চালিয়ে থাকেন। সকল কামনা-বাসনার টুটি চেপে ধরে নিজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পশুত্ব ও আমিত্বকে কোরবান করে এক নতুন চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে নতুন মানবরূপে সমাজে প্রত্যাবর্তন করেন। এই নবরূপে আবির্ভূত মানুষটি চরিত্র, আদর্শ ও নৈতিকতায় একজন ‘ইনসানে কামিল’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার দীক্ষা লাভ করেন। ফলে তিনি সমাজে অবস্থিত মানুষগুলোকে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার গুণে গুণান্বিত করতে সচেষ্ট হন।

বারো. হজযাত্রীরা পবিত্র হজ পালনে গিয়ে ইসলামের অভ্যুদয় ও বিকাশের বিভিন্ন পথ পরিক্রমার ইতিহাসের একেকজন বাস্তব ও প্রত্যক্ষদর্শীর অবস্থানে উপনীত হন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে তারা স্মৃতির মানসপটে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ রোমন্থন করতে গিয়ে দেখতে পান, মক্কায় কীভাবে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে, আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা কী পরিমাণ ত্যাগ ও কোরবানির নজরানা পেশ করেছেন, কোন প্রেক্ষাপটে তারা আপনজন ও সহায়-সম্পদ ফেলে প্রিয়-মাতৃভূমি থেকে হিজরত করেছেন, কীভাবে তারা চাপিয়ে দেওয়া অসম যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে শাহাদাত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, দ্বীনের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কীভাবে তারা চরম শত্রুর সঙ্গে সন্ধি-চুক্তি স্থাপন করেছেন; আবার কীভাবে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেছেন। এসব ঘটনার সারনির্যাস থেকে তারা চলার পথে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশ্ব মুসলিমের সংকট উত্তরণে অনবদ্য অবদান রাখতে পারেন।

তেরো. বিদায় হজে ৯ জিলহজ তারিখে মহানবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে যেই ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেছেন এটি বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে বিবেচিত। এতে রাসুল (সা.) বিশ্বমানবতার জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম সংরক্ষণের গ্যারান্টি প্রদান করেছেন, আমানত রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছেন, সুদ প্রথা বিলুপ্ত করেছেন, নারীর অধিকার সুসংহত করেছেন, সর্বোপরি তিনি আদম সন্তান হিসেবে সাম্যের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেছেন। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে Universal Declaration of Human Rights তথা মানবাধিকারের সার্বজনীন যে ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে রাসুল (সা.)-এর ভাষণে তার সবগুলোই অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে দৃষ্টান্ত দেখা যায় মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ অনুসরণ করা হলে তা আর থাকবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

চৌদ্দ. ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ফরজ ঘোষণা করেছে। অথচ মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় অন্যদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। কোরআনে আল্লাহর শত্রু ও মুসলিমের শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলার জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রতি তাগিদ প্রদান করা হয়েছে এবং সুসজ্জিত অশ্ব প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে, যাতে শত্রুর হৃদয়ে ভীতি সঞ্চারিত হয়। (সুরা আনফাল : ৬০)। এর জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের সামরিক প্রশিক্ষণের। পবিত্র হজের বিধি-বিধান পালনে মূলত সামরিক প্রস্তুতির গুরুত্বের বিষয়টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নাম তালিকাভুক্তি, অতপর প্রশিক্ষণের নিমিত্তে তাঁবুতে অবস্থান, দৈহিক কসরত ও শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে সমরাস্ত্রের ব্যবহার। পবিত্র হজে সামরিক প্রশিক্ষণের সবগুলো দিক এবং বিভাগই বিদ্যমান। পরিশেষে বলতে পারি, বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে গভীর সংকটে নিমজ্জিত। আর এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হলো, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, নিজেদের মধ্যকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্য ও সংহতি জোরদার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, উন্নত সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধিলাভ, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও প্রচার মাধ্যমের বিকাশ, মানবাধিকার সুসংহতকরণ; সর্বোপরি নিজেদের সোনালি অতীতে পুনরুদ্ধারকল্পে আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হওয়া। আর পবিত্র হজের শিক্ষা ও দর্শনে এর সবগুলো অনুষঙ্গই বিদ্যমান। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শনের ভূমিকা অপরিসীম।

(প্রবন্ধটি বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র ঢাকার উদ্যোগে গত ২৪ মে ২০২৫ অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শন’ শীর্ষক সেমিনারে পঠিত হয়।)

লেখক : প্রফেসর, আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত