আল্লাহর নামের জিকির হলো আত্মার প্রেরণা, হৃদয়ের জখমের চিকিৎসা, চরিত্রের পরিচ্ছন্নতার চিহ্ন, মন খুশির কারণ এবং সফলতা ও মুক্তির প্রকৃত পথ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা আনফাল : ৪৫)। যে নিয়মিত আল্লাহর জিকির করে, তার ওপর আল্লাহর আলো বর্ষিত হয়, তাঁর রহমতের চিহ্ন প্রকাশ পায়, তাঁর করুণা বর্ষিত হয়, তার জীবনে বরকতের ধারা প্রবাহিত হয়।
জিকির এক উত্তম রসদ, লাভজনক ব্যবসা, ভারি পাল্লার ওজনদার আমল। এর ফল এতটাই কাছের ও স্পষ্ট যে, তা চোখে দেখা যায়, হৃদয়ে অনুভব করা যায়। কবি চমৎকার বলেছেন, ‘নেক আমলের আশায় থাকা হে মানুষ এবং বরকত ও কল্যাণপ্রত্যাশী ব্যক্তি, আল্লাহর জিকির করো। যে তাঁকে স্মরণ করে, আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন। আর যে তাঁকে স্মরণ করে, আল্লাহও তাকে স্মরণ করেন।’ আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আমাকেই স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ১৫২)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন, সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি।’ (বোখারি : ৭৪০৫)।
আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের অধিক পরিমাণে জিকির, তাসবিহ ও পবিত্রতা প্রকাশ করতে আদেশ করেছেন। এজন্য তিনি মহাপুরস্কার ও উত্তম পরিণতি নির্ধারণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। তাঁর ফেরেশতাগণও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে অন্ধকার থেকে তোমাদের আলোকে আনার জন্য। আর তিনি মোমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব : ৪১-৪৩)।
আমাদের সময়গুলোতে কত গাফিলতি ও ভুলভ্রান্তি চলে! আমরা দুনিয়ার কথাবার্তায় কত সময় নষ্ট করি, অথচ তাতে আমাদের কোনো ক্লান্তি বা বিরক্তি নেই। আমরা পরনিন্দা, চোগলখোরি, গিবত ও বেহুদা কথায় এত বেশি সময় ব্যয় করি যে, একবার ‘সুবহানাল্লাহ’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কিংবা ‘আল্লাহু আকবার’ বলার সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়, যা আমাদের অনেক মর্যাদা ও কল্যাণ এনে দিতে পারত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে সমস্ত লোক কোনো দরবারে বসেছে অথচ তারা আল্লাহতায়ালার জিকির করেনি এবং তাদের নবীর প্রতি দরুদও পড়েনি, তারা বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হবে। আল্লাহতায়ালা চাইলে তাদের শাস্তিও দিতে পারেন কিংবা মাফও করতে পারেন।’ (তিরমিজি : ৩৩৮০)।
জিহ্বার জিকির- যা হৃদয়ের সঙ্গে মিল রেখে হয়- এটি সবচেয়ে উত্তম নেক আমল, শ্রেষ্ঠ ইবাদত ও সহজতর উপাসনা। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের তোমাদের অধিক উত্তম কাজ প্রসঙ্গে জানাব না, যা তোমাদের মনিবের কাছে সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের সম্মানের দিক থেকে সবচেয়ে উঁচু, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান করার চেয়েও বেশি ভালো এবং তোমাদের শত্রুর মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের তোমাদের সংহার করা ও তোমাদের তাদের সংহার করার চেয়ে ভালো? তারা বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর জিকির’।
আল্লাহর জিকির রহমানকে সন্তুষ্ট করে, শয়তানকে দূর করে, ঈমানকে মজবুত করে, মন থেকে দুঃখ-চিন্তা দূর করে, হৃদয়কে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ : ২৮)। আল্লাহর জিকির- একাকিত্ব দূর করে, হৃদয়ের কঠোরতা গলিয়ে দেয়, গাফিলতি সরিয়ে দেয়, আল্লাহর রহমত নামিয়ে আনে ও হৃদয়কে রোগমুক্ত করে। আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একপ্রকার ময়লা দূর করার উপায় আছে। আর অন্তরের ময়লা দূর করার উপায় আল্লাহর জিকির।’ আল্লাহর জিকির- তৃষ্ণার্ত আত্মার জন্য পানীয়, শূন্য হৃদয়ের জন্য খাদ্য, কণ্টকাকীর্ণ পথের জন্য আলো। এ জিকিরের মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণ আসে, বিপদ দূর হয়, বিপর্যয় সহজ হয়ে যায় এবং কষ্ট ও দুঃখ হালকা হয়। আল্লাহর নাম এমন কোনো বিপদে স্মরণ করা হয়নি- যা সহজ হয়ে যায়নি। এমন কোনো দুঃখে স্মরণ করা হয়নি- যা কেটে যায়নি।
আল্লাহর জিকিরের যে প্রতিদান আছে, তার মহত্ত্ব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোনো মানুষ পুরোপুরিভাবে তা উপলব্ধিও করতে পারে না। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে কেউ কি প্রতিদিন এক হাজার পুণ্য হাসিল করতে অপারগ হয়ে যাবে? তখন সেখানে উপবিষ্টদের মধ্য থেকে এক প্রশ্নকারী প্রশ্ন করল, আমাদের কেউ কীভাবে এক হাজার পুণ্য হাসিল করবে, তিনি বললেন, সে ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করলে তার জন্য এক হাজার পুণ্য লিখিত হবে।’ (মুসলিম : ৬৭৪৫)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক একশত বার পড়বে-
বাংলা উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির।’
বাংলা অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাসক নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই, রাজত্ব একমাত্র তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র তাঁরই জন্য, আর তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান।’ তাহলে দশটি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব তার হবে। তার জন্য একশতটি সওয়াব লেখা হবে ও একশতটি গোনাহ মিটিয়ে ফেলা হবে। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সে শয়তান থেকে নিরাপদ থাকবে। কোনো লোক তার চেয়ে উত্তম সওয়াবের কাজ করতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, ওই ব্যক্তি সক্ষম হবে, যে এর চেয়ে ওই দোয়ার আমল বেশি পরিমাণ করবে।’ (বোখারি : ৩২৯৩)।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাতের শেষে তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’, তেত্রিশবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও তেত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে; আর এভাবে নিরানব্বই বার হওয়ার পর শততম পূর্ণ করতে বলবে-
বাংলা উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা লারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। তার গোনাহগুলো সমুদ্রের ফেনারাশির মতো অসংখ্য হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (মুসলিম : ১২৩৯)।
আল্লাহর জিকির ঘরকে জিন ও শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। আমাদের ঘর যেন আল্লাহর জিকির ও ইবাদতশূন্য না হয়। আবু মুসা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় আর যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় না, এ দুটি ঘরের তুলনা করা যায় জীবিত ও মৃতের সঙ্গে।’ (মুসলিম : ১৭০৮)। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ঘরে আল্লাহর জিকির করা সুন্নত ও উৎসাহব্যঞ্জক, আর ঘর কখনো জিকিরশূন্য করা উচিত নয়। জাবের ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, তিনি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ ও খাবার গ্রহণের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, তখন শয়তান হতাশ হয়ে তার সঙ্গীদের বলে, তোমাদের এখানে রাত যাপনও নেই, খাওয়াও নেই। আর যখন সে প্রবেশকালে আল্লাহর নাম স্মরণ না করে তখন শয়তান বলে, তোমরা থাকার জায়গা পেয়ে গেলে। আর যখন সে খাবারের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ না করে, তখন সে বলে, তোমাদের নিশিযাপন ও রাতের খাওয়ার আয়োজন হলো।’ (মুসলিম : ৫১৫৭)।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবর বানিয়ো না। কেননা, যে ঘরে সুরা বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, শয়তান সেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়।’ (মুসলিম : ১৭০৯)।
(০৯-০১-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ০৪-০৭-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)