ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কারবালার লক্ষ্য ও শিক্ষা

রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা

ইমাম হোসাইন (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় নাতি। নবীজির ইন্তেকালের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে এক অসম যুদ্ধে তিনি নানাজানের উম্মতের লোকদের হাতে নির্মমণ্ডনিষ্ঠুরভাবে শাহাদত বরণ করেন। এ কারণে গোটা মুসলিম উম্মাহ যুগ থেকে যুগান্তরে এই বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডের জন্য মর্মাহত ও শোকাবিভূত।

বাংলা সাহিত্যের বিশাল অঙ্গনজুড়ে সেই শোক ও মাতমের আহাজারি শোনা যায়। নজরুল কাব্যের ‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া, আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’ এখনও কারাবালার বিয়োগান্ত ঘটনার প্রতিধ্বনি শোনায়। মীর মশররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুর কারবালা প্রতি বছর মহররমে ফিরে আসে ‘কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়’।

১০ মুহাররম আমাদের জাতীয় ছুটির দিন। সমগ্র দেশবাসী বিভিন্ন আঙিকে এই দিবস পালন করে। জাতীয় নেতারা সংবাদপত্রে ও মিডিয়ায় বাণী দিয়ে বলেন, ইমাম হোসাইন সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, অসত্যের সামনে মাথানত করেননি। আমরা বলি, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছিলেন ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে।

মওলানা মুহাম্মদ আলি জরহরের বলে পরিচিত দুই লাইনের একটি উর্দু কবিতার প্রাণ উদ্দীপক বক্তব্য হলো-

‘কতলে হুসাইন আসল মে মর্গে এজিদ হে

ইসলাম জিন্দা হোতা হে হার কারবালা কে বাদ।

হোসাইন নিহত হওয়া মূলত এজিদের মরণ

ইসলাম প্রাণ ফিরে পায় প্রতিটি কারবালার পরে।

ইসলামের ইতিহাসে কোনো বিপর্যয় নেই, প্রতিটি বিপর্র্যয়ের পরেই ইসলামের নতুন প্রাণ শক্তির সঞ্চার হয়েছে, মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ইমাম হোসাইন কোন সত্য ও ন্যায়ের জন্য সপরিবারে শহিদ হয়েছেন কিংবা কোনো ধরনের ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে শাহাদতের নজরানা পেশ করতে হয়েছিল। তখন তো নামাজ ঠিকমতোই পড়া হতো, রমজানের রোজা সবাই পালন করত, হজও যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হতো। মক্কা, মদিনা, কুফা দামেস্কে তো প্রচলিত ইসলামের বিরুদ্ধে বড় কোনো কিছু হয়নি। এরপরও ইমাম হোসাইনকে প্রথমে মদিনা ছেড়ে মক্কায়, তারপর কুফার উপকণ্ঠে কারবালায় যেতে হলো কেন। তার দ্বিখণ্ডিত মাথা মোবারক কেন অপমানজনকভাবে দামেস্কে ইবনে জিয়াদের সামনে মাটিতে আবার দামেস্কে এজিদের দরবার হলে রাখা হলো? সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য কিংবা দ্বীন ইসলামকে জীবিত রাখার জন্য ইমাম হোসাইন শহিদ হয়েছেন বলে যারা বয়ান দেন, তারা এ প্রশ্নটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন কি না, জানি না।

ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলাম, ইসলামি রাষ্ট্র, খেলাফত ও উম্মাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, যে বিপদের ঘনঘটা তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, অন্যরা তা দেখতে পাননি। ইমামের সেই উৎকণ্ঠা ছিল খেলাফতের সর্বোচ্চ আসন, উম্মাহর জাতীয় নেতৃত্ব এমন কোনো পাপাচারী, অযোগ্য স্বৈরাচারির হাতে ন্যস্ত হওয়ার ঝুঁকি, যে আল্লাহ ও রাসুল নির্ধারিত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল গণ্য করার ব্যাপারে বেপরোয়া ছিল।

এজিদের মতো অযোগ্য পাপাচারি লোক খেলাফতের মসনদ দখল করবে আর রাসুলের নাতি তার হাতে হাত রেখে আনুগতের শপথ নেবে তা হতে পারে না। খাজা মুইন উদ্দীন চিশতি (রহ.) ঠিকই বলেছেন-

সর দাদ ন দাদ দস্ত দর দস্তে এজিদ

হক্কা কে বেনায়ে লা ইলাহাস্ত হোসাইন।

তিনি মাথা দিয়ে দিয়েছেন তবু এজিদের হাতে হাত দেননি

সত্যিই হোসাইন হলেন ইসলামের ভিত্তি মাপকাঠি।

বস্তুত ইমাম হোসাইনের লক্ষ্য ছিল, সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে ইসলামি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রপ্রধান হতে হবে ইসলামের সত্যিকার অনুসারী, নচেত তাকে মান্য করা যাবে না, তার প্রতি সমর্থন, আনুগত্যের হাত বাড়ানো যাবে না। এই বার্তা ইমাম হোসাইন দিয়ে গেছেন আশুরা আন্দোলনে কারবালা প্রান্তরে নিষ্ঠুরভাবে শাহাদতের নজরানা পেশ করে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো আর তোমাদের মধ্যে যারা উলুল আমর (সার্বিক কর্তৃত্বের অধিকারী) তাদের আনুগত্য করো।’ (সুরা নিসা : ৫৯)। আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ নিষেধ পালনের উদ্দেশ্যে যিনি রাষ্ট্রক্ষমতা বা জাতীয় জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেবেন তিনিই উলুল আমর। বর্তমানে উলুল আমরের আনুগত্যের চেতনা আমরা নিছক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি। অথচ তা ইসলামের আচরিত কর্মপন্থার পরিপন্থি।

জাতীয় জীবনে একজন ধর্মপ্রাণ নেতার গুরুত্ব কতটুকু, তা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে আবার প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকা তার দোসর ইসরায়েলকে নিয়ে ইরানের ওপর হামলা করে গত মাসে। প্রথম দিনেই ইরানের প্রথমস্তরের অন্তত ৬০ জন সামরিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা এ হামলায় নিহত হয়। কিন্তু ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ডাকে ইরানিরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। একবারে পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ইরান ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলকে পর্যুদস্ত করে, তেলাবিব ও হাইফা তছনছ করে দেয়। কাতার, সিরিয়া, ইরাকের মার্কিন ঘাটিতে হামলা চালিয়ে আমেরিকার গালে চপেটাঘাত লাগায় এবং আগ্রাসী শক্তিকে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করতে বাধ্য করে।

ইসলামের প্রচার প্রতিষ্ঠা ও মুসলিমজাতির ইহ-পরকালীন জীবনে নেতৃত্বের এই গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য একটি আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যেদিন আমি প্রত্যেক মানুষকে তার নেতাসহ আহ্বান করব।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭১)। তার সংক্ষিপ্ত ও সরল অর্থ হলো, যে লোক দুনিয়ার জীবনে যাকে নেতা হিসেবে মান্য করে চলবে, কিয়ামতের দিন সেই নেতার সঙ্গেই তার হাশর হবে। এখন চিন্তা করুন, আমরা দুনিয়ার জীবনে কাকে নেতা হিসেবে মান্য করছি, কার অনুসৃত আদর্শ অনুসরণ করছি, কার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করছি? আখেরাতে তার যে পরিণতি হবে, সেই পরিণতি ভোগ করতে পারব কি না।

মসজিদে নববিতে নবীজি (সা.) নামাজে আসছেন, মসজিদে অপেক্ষমাণ সবাই সচকিত। কিন্তু এক সাহাবি মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছিল। নবীজি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন তুমি। সাহাবি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ‘কিয়ামত কখন হবে।’ নবীজি এগিয়ে গেলেন, জামাত কায়েম হলো। নামাজ শেষে তিনি লোকটিকে ডাকলেন। ভয়ে তো তার পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। এই প্রশ্নে কোনো বড় ভুল হয়ে গেল নাকি। নবীজি প্রশ্নটি আবার জিজ্ঞাসা করার পর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুমি যে কেয়ামত কবে জানতে চেয়েছ, আমাকে বলো, এর জন্য তুমি কী কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ। উৎসুক সাহাবিরা উৎকণ্ঠিত।

সাহাবি বিনয়ের সঙ্গে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, কেয়ামতের প্রস্তুতি বলতে বেশি বেশি নামাজ রোজার কোনো সঞ্চয় আমার কাছে নেই। তবে একটি বিষয়ে আশায় বুক বেঁধে আছি। তা হলো, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি। সবাই নবীজির পবিত্র জবানের দিকে তাকিয়ে আছেন, কী উত্তর দেন। তিনি বললেন, তুমি যাকে ভালোবাস তার সঙ্গেই তোমার হাশর হবে।’ (বোখারি)। হাদিসের বর্ণনাকারী আনাস (রা.) বলেন, ‘সেদিন মদিনার ঘরে ঘরে, অলি-গলিতে ঈদের আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। কারণ, নবীজির উক্তিতে সুসংবাদ ছিল মদিনাবাসীর জন্য। তারা নবীজিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন। নবীজির জন্য যুদ্ধবিগ্রহ নানা হুমকি মাথায় পেতে নিয়েছেন। এখন এই ভালোবাসার প্রতিদানের নিশ্চয়তা পেলেন। তা হলো, মৃত্যুর পর পরকালেও তারা নবীজির সঙ্গে থাকতে পারবেন।

সূত্র : ৬ জুলাই ঢাকা বায়তুশ শরফ মসজিদে ১০ মহররম শাহাদাতে কারবালা শীর্ষক আলোচনা ও দোয়া মাহফিলে আলোচনার সারসংক্ষেপ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত