ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ ভাদ্র ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাবার অনুপ্রেরণায় ফুটবলে আফঈদা

বাবার অনুপ্রেরণায় ফুটবলে আফঈদা

একটা সময় দেশের ক্রীড়াঙ্গণে মেয়েদের নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ ফুটবলকে দেখত ‘পুরুষের খেলা’ হিসেবে। মেয়েরা মাঠে গিয়ে বল খেলবে- এটা ছিল কল্পনার মতোই ব্যাপার। মেয়েদের প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে, খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবারের সদস্যরাই। পরিবার বাধা দেয় মূলত সমাজের চোখ রাঙানি, প্রতিবেশিদের তিরস্কার, ধর্মীয় বাধা নিষেধের ভয় ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে। অসংখ্য মানুষের সামনে মেয়েরা হাফপ্যান্ট, জার্সি পড়ে খেলবে, ছুটবে, দৌড়াবে, পরিবার ও সমাজের অভিভাবকরা তা মানতে পারেন না। ফলে যে মেয়েরা মাঠে খেলতে নামে তাকে ও তার পরিবারকে পদে পদে সহ্য করতে হয় সমাজের কটু কথা, টিপ্পনি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, গঞ্জনা ও অপবাদ। তবে এসব ধারণার পরিবর্তন আসতে শুরু করে

২০১১ সালে যখন সরকারিভাবে দেশজুড়ে প্রাথমিক স্কুলের মেয়েদের জন্য চালু করা হয় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় তখন আর কোনো পক্ষের বিরোধিতাই ধোপে টিকেনি। সেই টুর্নামেন্ট ঘিরেই বলা চলে, আজকের তরুণী আর তখনকার কিশোরীদের ফুটবল যাত্রা শুরু। সানজিদা, মারিয়া, সাবিনা, মণিকারা নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সেই পথ ধরেই জোর কদমে সামনে এগিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য ট্রফি জিতেছেন। এখন দলের হাল ধরেছেন এক ঝাক নতুন তারকা। তাদেরই একজন আফঈদা খন্দকার। ১৮ বছর বয়সী বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক এখন বাংলাদেশের গর্ব। তিনি নারী ফুটবল দলের একজন উদীয়মান তারকা। সাতক্ষীরার মেয়ে আফঈদা এর আগে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে অধিনায়কত্ব করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

আফঈদা খন্দকার প্রান্তির ফুটবল যাত্রা শুরু হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। সাতক্ষীরার সুলতানপুর গ্রামের খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্স এর ছোট কন্যা আফঈদা। খুব ছোট বেলা থেকেই তিনি বাবার কাছে ফুটবল অনুশীলন করতেন। বাবা ছিলেন একজন ফুটবল অনুরাগী এবং তার অনুপ্রেরণাতেই আফঈদার ফুটবলের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। বাবার হাতে গড়া স্টুডেন্টস ফুটবল একাডেমি থেকে আফঈদার উঠে আসা। ওই ফুটবল একাডেমিতে এখনও অনেক মেয়ে অনুশীলন করেন। তার এই একাডেমি থেকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপিতে) ফুটবল, হকি, জিমন্যাস্টিকস, জুডোতে অনেক মেয়ে ভর্তিও হয়েছেন। আফঈদা সাতক্ষীরা জেলা দলের হয়ে বয়সভিত্তিক ফুটবলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) নারী ফুটবল শুরু করে। সে বছর ৫ম শ্রেণিতে ফুটবল বিভাগে ভর্তি হন আফঈদা। ২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট সুব্রত মুখার্জি কাপ অনূর্ধ্ব-১৭ বালিকা ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে ২০১৯ সালে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয় আফঈদা। এরপর ২০২৪ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ এ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান সাতক্ষীরার মেয়ে আফঈদা খন্দকার। তার নেতৃত্বে দলটি নতুন নতুন সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

আফঈদা ২০১৯ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন। ঐ আসরে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০২২ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিপক্ষে মাত্র ৪৩ সেকেন্ডে গোল করে অনন্য রেকর্ড অর্জন করের আফঈদা। এই আসরে বাংলাদেশ রানার্স আপ হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-২০ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই দলেও খেলেছেন আফঈদা।

২০২৩ সালে হুয়াংজু এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল অংশগ্রহণ করে। সেই দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন আফঈদা খন্দকার। এছাড়া ২০২৩ সালে ফিফা টায়ার-১ ম্যাচে নেপাল ও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলেছেন। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর দলের বিপক্ষে ৩ মিনিটে হেডের মাধ্যমে গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। এ বছর মে মাসে জর্ডানে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে অধিনায়ক এর দায়িত্ব পালন করেন আফঈদা। সম্প্রতি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে স্বাগতিক মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে মূল পর্বে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছে লাল-সবুজের নারী দল। যে দলটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আফঈদা। ঢাকায় অনুষ্ঠানরত অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৫’এ অধিনায়কের দায়িত্বও পেয়েছেন আফঈদা।

আফঈদার বাবা সাতক্ষীরা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ক্রীড়া সংগঠক খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্স জানান, আফঈদা এরমধ্যেই সাতটি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন। তার নেতৃত্বে আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুইটি, জর্ডান এবং ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে দুইটি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ এএফসি এশিয়ান কাপ কোয়ালিফাই তিনটি ম্যাচে জয়লাভ করে চূড়ান্ত পর্বে টিকিট নিশ্চিত করেছে। আফঈদা খন্দকার বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৫, ১৮, ১৯, ২০ এবং সর্বশেষ জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং তার নেতৃত্বে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে চলতি বছরে জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়কের নেতৃত্বে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা সবাই আফঈদার জন্য দোয়া করবেন। আগামী বছরের মার্চে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করবে। প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে অংশ নিয়ে জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের মেয়েরা যেন মানুষের আশা পূরণ করতে পারে, সে জন্য সবাই দোয়া করবেন। আশা করি আফঈদার হাত ধরে সাতক্ষীরার ক্রীড়াঙ্গন এগিয়ে যাবে এবং নতুন প্রজন্মের মেয়েরা আরও উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি সাতক্ষীরা থেকে যাতে আরও অনেক ভালো মানের খেলোয়াড় বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সেজন্য সবার সহযোগিতা আশা করছি। এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করবে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাবা হিসেবে এজন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত, আমার পরিবারও গর্বিত। সাতক্ষীরাবাসী আমাদের যেভাবে উৎসাহিত করেছে তা অকল্পনীয়। তার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করেছেন তিনি।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার বলেন, সাতক্ষীরা আমার শিকড়, এখান থেকেই আমার ফুটবল যাত্রা শুরু। ভবিষ্যতে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আসরেও নিজেকে আরও পরিণত খেলোয়াড় হিসেবে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছেন আফঈদা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত