
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জাহানারা আলম। ২০১১ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর ৫২টি ওয়ানডে এবং ৮৩টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। বিরুপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন ৩২ বছর বয়সি এ পেসার। সেখান থেকেই এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলে খেলার সময় যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন সাবেক এ অধিনায়ক। জাহানারার অভিযোগের তীর নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার, সাবেক জাতীয় পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম এবং বিসিবির নারী বিভাগের সাবেক ইনচার্জ প্রয়াত তৌহিদ মাহমুদের দিকে। এছাড়াও অভিযোগ তুলেছেন তিনি সংশ্লিষ্ট আরও কজনের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে বিসিবিতে বিস্তারিত জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি বলে দাবি সাবেক এই অধিনায়কের।
এছাড়া তার ক্যারিয়ার ‘ধ্বংস করে দেওয়ার’ পেছনে জাতীয় দলের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কোচিং স্টাফ এবং খেলোয়াড়ের ভূমিকা ছিল বলেও দাবি করেছেন জাহানারা। তিনি বলেন, ‘উনি (মঞ্জুরুল ইসলাম) একদিন আমার কাছে আসলেন, আমার কাঁধে হাত রেখে বলছিলেন, তোর পিরিয়ডের কতদিন চলছে। পিরিয়ড শেষ হলে বলিস, আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। পিরিয়ড শেষ হলে, যখন ডাকবো চলে আসিস।’ মঞ্জুকে নিয়ে অন্য এক অভিযোগে জাহানারা বলেন, ‘বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচে যখন আমরা লাইনে হ্যান্ডশেক করি, তখন তিনি (মঞ্জুরুল) হ্যান্ডশেক না করে জড়িয়ে ধরতেন।’ জাহানারার এসব অভিযোগের পর বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, ‘জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এক সাবেক সদস্যের করা অভিযোগে দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির অসদাচরণের উল্লেখ রয়েছে।’ বিসিবি জানিয়েছে, অভিযোগগুলোর সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিটি আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে। সংস্থাটি আরও জানায়, ‘সব খেলোয়াড় ও কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বোর্ড বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের শুরুর সময়ের সেনানীদের একজন জাহানারা। দীর্ঘদিন দেশের পেস আক্রমণ বলতে গেলে একাই টেনেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের সফলতম পেসার তিনিই। নেতৃত্বও দিয়েছেন জাতীয় দলকে। বিদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা বাংলাদেশের একমাত্র নারী ক্রিকেটার তিনিই। ৩২ বছর বয়সি পেসারকে সবশেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গেছে গত ডিসেম্বরে। এখন তিনি থিতু হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে ক্লাব ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি কোচিং কোর্স করছেন। জাহানারা অভিযোগগুলো করেছেন ফ্রিল্যান্স ক্রীড়া সাংবাদিক রিয়াসাদ আজিমের ইউটিউব চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকারে। নিউজিল্যান্ডে ২০২২ বিশ্বকাপ চলার সময় নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জু তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়াও মঞ্জুর বিরুদ্ধে নানা সময়ে যৌন হেনস্তা, মানসিক নির্যাতন ও প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বাজে আচরণ করার অভিযোগও তুলেছেন এই পেসার। একইরকম অভিযোগ করেছেন তিনি নারী ক্রিকেটের সাবেক ইনচার্জ তৌহিদের বিরুদ্ধে, একসময় যিনি ছিলেন সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের ব্যক্তিগত সহকারী। কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাহানারা। এছাড়াও টিম ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডের আরও কজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে তার। এসব নিয়ে নারী বিভাগের সেই সময়ের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম চৌধুরিকে কয়েক দফায় জানালেও তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে সাময়িক সমাধান করেছেন বলে অভিযোগ জাহানারার। পাশাপাশি বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরীকে বিস্তারিত লিখিত জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান এই ক্রিকেটার। জাহানারা দাবি করেন, আরও অনেক ক্রিকেটার নানাভাবে এসবের শিকার হলেও বিভিন্ন শঙ্কায় মুখ খোলেন না। প্রথম বিভাগের একজন ক্রিকেটারের যৌন হেনস্তার শিকার হওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় পড়ে যায় দেশের ক্রিকেট আঙিনায় ও সামাজিক মাধ্যমে। পরে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিবৃতি দিয়ে বিসিবি জানায়, ‘স্পর্শকাতর’ এই অভিযোগগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে যারা তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জানাবে। সব ক্রিকেটার ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নিরাপদ, সম্মানজনক ও পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিসিবি নিবেদিত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে। এই ধরনের ব্যাপারগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানায় বোর্ড।
কয়েকদিন আগে দৈনিক কালের কণ্ঠকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জাহানারা গুরুতর কিছু অভিযোগ করেছিলেন নারী দলের ভেতরের নানা কিছু ও ড্রেসিং রুমের পরিবেশ নিয়ে। অধিনায়ক নিগার সুলতানাকে কাঠগড়ায় তোলেন তিনি দলে আধিপত্য বিস্তার, সিন্ডিকেট তৈরি, ক্রিকেটারদের মারধর করা, জুনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করাসহ নানা অভিযোগে। এছাড়াও সহ-অধিনায়ক নাহিদা আক্তার, সিনিয়র ক্রিকেটার ফারজানা হক ও রিতু মনির দিকেও একই ধরনের অভিযোগ তিনি তোলেন। পরে রিয়াসাদ আজিমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও জাহানারা এক পর্যায়ে বলেন, নিগার-নাহিদা-ফারজানা-রিতুদের তিনি কখনও ক্ষমা করবেন না। বিসিবি অবশ্য সেসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও সত্য-বিবর্জিত’ বলে উড়িয়ে দেয়।