ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দোষচর্চা ডেকে আনে পাপ

আশরাফুল ইসলাম
দোষচর্চা ডেকে আনে পাপ

মানুষের আড়ালে বা সামনে দোষচর্চা করা, নিন্দা-কুৎসা রটনায় লিপ্ত হওয়া কোনো মুসলমানের কাজ নয়। সামাজিকভাবেও এটা নিন্দনীয় বিষয়। আরবিতে এটাকে বলা হয় ‘গিবত’, যার অর্থ- পরনিন্দা করা, অগোচরে বা গোচরে অন্যের দোষ বর্ণনা করা। এই পরনিন্দা ইসলামি বিধান অনুসারে পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং কবিরা গোনাহ। এমনকি হাদিসে এসেছে যে গিবতকারী কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)। অন্যত্র এসেছে, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে মানুষের নিন্দা করে।...অবশ্যই তারা হুতামায় (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বালিত অগ্নি, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে, দীর্ঘায়িত স্তম্ভগুলোয়।’ (সুরা হুমাজা : ১-৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে এরশাদ করেন যে, ‘যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ’। (মুসলিম)। ইসলামের দৃষ্টিতে পরনিন্দা করা যেমন পাপ, পরনিন্দা শ্রবণ করাও তেমনি পাপ। অথচ এই পাপের কাজটি চায়ের আসর থেকে শুরু করে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় যেন স্বভাবসুলভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, এখন তো কোনো বৈঠক গিবত ও পরনিন্দা ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেকেই পরনিন্দাকে পাপ বা নিষিদ্ধ কোনো কিছু বলে মনেই করেন না। মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ হলো গিবত। কেননা, এসব পাপ তওবার দ্বারা ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা করলেই মাফ হবে না, বরং যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি মাফ করে তা হলেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যাবে।

অনেকে ভাবতে পারেন আমি তো গিবত করি না। অন্যরা বলে আমি শুধু শুনি। না, তাদেরও রক্ষা নেই। কারণ তারা গিবতকারীকে সাহায্য করছে এই পাপ কাজ করতে। গিবতকারী গিবত করার জন্য যদি কাউকে না পায় তা হলে সে আর গিবত করতে পারবে না। তাই গিবত শ্রবণকারীদের জন্যও রয়েছে আল্লাহর আজাব। যে গিবত শোনে সেও গিবতের পাপের অংশীদার হয়ে যায়। হাদিস শরিফে আছে, যখন কেউ আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামতে বলুন, আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাবধান করুন। আর তাতেও যদি কাজ না হয়, তবে সেখান থেকে সরে আসুন; কোনোভাবেই গিবত শোনা যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত বা পরনিন্দা কাকে বলে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন।’ অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কোনো কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত’। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করাই গিবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তা হলেও কি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর তুহমত ও বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছ।’ (মুসলিম)।

গিবত ও পরনিন্দার শাস্তি অনেক ভয়াবহ হবে। একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন আমাকে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে তামার নখবিশিষ্ট এক দল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল, এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখুরি করত।’ (আবু দাউদ)। অর্থাৎ শুধু গিবত ও চোগলখুরির জন্য আল্লাহতায়ালা এমন শাস্তি দিয়েছেন যে, নিজেই নিজেকে শেষ করে জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

কারও ভুল-ত্রুটি চোখে পড়লে ও সংশোধনের প্রয়োজন মনে হলে সরাসরি তাকে বলা যায়। কাছে ডেকে বা কাছে গিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে উপদেশ দেওয়া যায়। কিন্তু তাকে না বলে অন্যদের কাছে দোষ বলে উল্লাস করা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সমালোচনাকারীকে বিচারের দিনে নিজের নেক আমল দিয়ে এর বিনিময় পরিশোধ করতে হবে। যার সমালোচনা করেছে, তার গুনাহ নিয়ে সমালোচনাকারীকে জাহান্নামে যেতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, গিবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। কারণ কোনো ব্যক্তি জেনার পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ কখনো মাফ করবেন না’ (মুসলিম)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গিবতের কাফফারা হলো তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে বলবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।’ (বায়হাকি)।

দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ পরনিন্দা ও দোষচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ স্বভাবগুলো ‘আখলাকে সাইয়িআ’ নামে পরিচিত। এর কারণে মানুষের অধঃপতন সুনিশ্চিত। পরনিন্দাকারী মানুষ নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করে যার ফলে তার অন্তরও কলুষিত হয়।

লেখক : ইসলামি গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত