আল্লাহতায়ালার দেয়া নেয়ামতের মধ্যে একটি বড় নেয়ামত হলো চোখ। চোখের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহরতায়ালার সৃষ্টিসমূহ দেখি, তারপর চিন্তা ও উপলদ্ধি করে জ্ঞান অর্জন করি। ইমাম কুরতবি (রহ.)-এর মতে, ‘চোখ অন্তরে কোনো কিছু প্রবেশের বড় দরজা’। অর্থাৎ চোখ হলো মানবাত্মার চিন্তার খোরাকের প্রবেশদ্বার। অন্তরে প্রশান্তি আর পরকালে সুখময় জীবন লাভের জন্য চোখের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বড় বড় পাপ কাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও চোখের দৃষ্টির বিকল্প নেই। সাধারণত বড় বড় পাপ কাজ সম্পাদনের প্রাথমিক ধাপ হলো চোখ।
যেভাবে দৃষ্টির খেয়ানত হয় : চোখ দিয়ে হারাম কোনো বস্তু দেখে কুপ্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়াকে দৃষ্টির খেয়ানত বলে। বর্তমানে ইন্টারনেটের আবির্ভাবে ‘দৃষ্টির খেয়ানত’ সমস্যাটি সংক্রামণ ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আগে যেখানে দৃষ্টির খেয়ানতের জন্য রাস্তাঘাট হাটবাজারের নারী-পুরুষ সম্বলিত পোস্টারকে দায়ী করা হতো, বর্তমানে হাতে থাকা মুঠোফোনেই এ কাজের জন্য যথেষ্ট হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রাশ কনফেশন, রিলস, টিকটক, পোস্ট প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা দৃষ্টির খেয়ানত করছি।
আল্লাহরতায়ালা যেখানে আমাদেরকে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলেছেন, সেখানে আমরা দিনের পর দিন বেগানা নারী-পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করে মনের কুপ্রবৃত্তিকে সতেজ করে তুলছি। সামাজিকমাধ্যমের আবির্ভাবের ফলে এখন কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবার পক্ষেই দৃষ্টির হেফাজত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
দৃষ্টি হেফাজতের গুরুত্ব : পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে মানুষ দিনদিন তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে ধ্বংসের দিকে আপতিত হচ্ছে। তাই সমাজকে এই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচাতে দৃষ্টি হেফাজতের বিকল্প নেই। দৃষ্টি হেফাজতের মাধ্যমেই একজন মুসলমান প্রকৃত মোমিনে পরিণত হতে পারে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘মোমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।‘(সুরা নুর : ৩০)।
দৃষ্টির মাধ্যমে শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দিতে যেমন উদ্ধত, তেমনি আল্লাহতায়ালাও দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে প্রশান্তি দান করতে সর্বদা প্রস্তুত। দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা মানুষের অন্তরে নুর সৃষ্টি করেন। আর এ নুরের কারণে একজন ব্যক্তির ইলমের পথ খুলে যায় এবং ইলমের সব উপকরণ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। এটি মানুষের অন্তরে তৃপ্তি, আনন্দ এবং উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। আমরা যখনই বেগানা কোনো নারী বা পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন আমাদের মনে অস্থিরতা কাজ করে। যার কারণে আমরা কাজে-কর্মে মনোযোগ দিতে পারি না, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। দৃষ্টির হেফাজতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা অন্তরের এসব অশান্তি, ছটফটানি, আফসোস থেকে মানুষকে হেফাজত করেন। এছাড়াও চোখের হেফাজত মানুষকে জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। কেননা কুদৃষ্টি মানুষকে অশ্লীল কাজের দিকে ধাবিত করে। দৃষ্টির হেফাজত দ্বারা মানুষের দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়। এ সম্পর্কে আল্লামা কিরমানি রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার বাহ্যিক দিকসমূহকে সুন্নাত দ্বারা সাজায়, আর সবসময় অন্তর দিয়ে আল্লাহর কথা চিন্তা করে, নিষিদ্ধ বস্তু হতে চোখকে হেফাযত করে, প্রবৃত্তিকে অন্যায় কর্ম হতে বিরত রাখে এবং হালাল খায়, সে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কখনোই অক্ষম হবে না।
দৃষ্টি সংযত নিয়ে নারীর ভুল ধারণা : দৃষ্টি সংযত নিয়ে আমাদের সমাজে নারীদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন আল্লাহতায়ালা কেবল পুরুষকেই দৃষ্টি সংযত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই একজন নারীর বেগানা পুরুষের দিকে তাকানোকে তারা তেমন ক্ষতিকর মনে করেন না। অনেক পর্দাশীল নারীদের অন্তরেও এ ভুল ধারণা লালিত আছে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এ কথা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, মোমিনা নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। (সুরা নুর : ৩১)।
উল্লেখ্য, লজ্জাস্থান হেফাজতের আগে আল্লাহতায়ালা দৃষ্টি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমাম ইবনু কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তারা যাতে তাদের স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পরপুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত না করে। এই জন্যই অধিকাংশ আলিমদের মতে, কামনার সঙ্গে হোক কিংবা কামনা-বাসনা ছাড়া হোক, উভয় অবস্থাতেই নারীদের জন্য বেগানা পুরুষের দিকে তাকানো নাজায়েজ। (তাফসিরে ইবনু কাসির : ৬/৪৫)।
এছাড়া আরেকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে নারীর দৃষ্টিপাতের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা ধারণা নিতে পারি। ‘একবার উম্মে সালামাহ (রা.) ও মাইমুনা (রা.) নবীজি (সা.)-এর নিকট বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় অন্ধ সাহাবি ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) এলেন। নবীজি (সা.) তখন তাদের দুজনকে বললেন, ‘তোমরা তার সামনে পর্দা করো (অর্থাৎ পর্দার অন্তরালে চলে যাও, তাকে দেখো না)।’ তখন উম্মে সালামাহ (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি তো অন্ধ, আমাদের তো দেখছেনও না, আবার আমাদের চিনেনও না। নবী (সা.) বললেন, (সে না হয় দেখছে না কিন্তু) তোমরা কি অন্ধ? তোমরা কি দেখো না?’ (তিরমিজি : ২৭৭৮)।
দৃষ্টি সংযত রাখার উপায় : দৃষ্টি সংযত রাখা মানে অন্ধ হয়ে চলা নয়, বরং হারাম বস্তুকে উপেক্ষা করে চোখের পবিত্রতা রক্ষা করা। চোখের মাধ্যমেই যেহেতু ফিতনার আশংকা বেশি থাকে, সেহেতু আমাদের দৃষ্টিকেই প্রথমে সংযত রাখতে হবে। আর দৃষ্টি সংযত রাখার প্রধান উপায় হলো দৃষ্টি অবনত রাখা। হারাম বা ফিতনার দিকে নিয়ে যায় এমন বস্তু থেকে সর্বদা দৃষ্টি অবনত রাখা। আর যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেসব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি চলে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া। দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলে সে বস্তুর প্রতি না তাকানো। কেননা, দ্বিতীয়বারের তাকানোতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থাকে। এছাড়া জীবন চলার পথে যখনই শয়তান দৃষ্টির খেয়ানত করার কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই কুদৃষ্টির ফলে অবধারিত জাহান্নামের শাস্তির কথা মনে করা, ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’- এভাবনা মনে হাজির করে আল্লাহকে স্মরণ করা। আল্লাহর জিকির মানুষকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করে এবং অন্তরে প্রশান্তি দান করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কোনো দল যখন তাদের ঘিরে ধরে, তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। (সুরা আল আরাফ : ২০১)।
পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের সঙ্কল্প : দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হলে বিশুদ্ধচিত্তে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার নিয়ত করতে হবে। প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আমরা যখন পাপ থেকে দূরে থাকার নিয়ত করি আল্লাহতায়ালা তখন আমাদের উপর খুশি হন। এ অনুভূতি হৃদয়ে জাগ্রত রাখতে হবে। হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, “আমার বান্দা যখন পাপ করার ইচ্ছা করে, তখন তোমরা তা আমলনামায় লেখো না, যতক্ষণ না সে ঐ পাপটি করে। যদি সে তা করে সমান পাপ লেখো। আর যদি সে তা আমার কারণে ত্যাগ করে, তাহলে তার ঐ পাপটি নেকি হিসেবে লেখো। যদি বান্দা নেক কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে ঐ নেক কাজটি করেনি, তাহলে তার জন্য তা নেকি হিসেবে লেখো।
অতঃপর যদি সে নেকি করে তাহলে তার জন্য ঐ নেকি দশগুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে লেখো। (বোখারি ও মুসলিম)। এ হাদিসের আলোকে আমরা যদি চোখের দৃষ্টি সংযত রাখার নিয়ত করি, নিয়ত বাস্তবায়ন করি হতে পারে আমাদের দৃষ্টি সংযত রাখার এ ইচ্ছা পোষণ এবং তা বাস্তবে লালন ও পালন করার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের নেকির পরিমাণ দশগুণ থেকে ২৭ গুণ বাড়িয়ে দেবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়