সুলতান মাহমুদ গজনভির প্রিয় গোলাম আয়াজ। গোলাম হলেও সুলতানের সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আয়াজ। তা নিয়ে দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী সভাসদদের ইর্ষার শেষ নেই। আয়াজের প্রতি তাদের হিংসা-বিদ্বেষ গাত্রদাহ দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। স্বয়ং সুলতানের সমালোচনায় মুখর হয় তারা। তাদের বক্তব্য, আয়াজের একার তো আমাদের ৩০ জন আমিরের সমান জ্ঞান নেই। তারপরও তাকে কেন ৩০ জনের সমান বেতন-ভাতা দেওয়া হবে। ন্যায়বিচারক সুলতান মাহমুদ দেখলেন মুখের জোরে রাজকর্মচারীদের যুক্তি খণ্ডানো যাবে না। কাগজে-কলমে প্রমাণ করে তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিতে হবে।
একদিন ৩০ জন উচ্চপদস্থ সভাসদ নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হলেন। বনপ্রান্তর দিয়ে কাফেলা এগিয়ে চলছে। সুলতান মাহমুদ সবার মধ্যমণি। সুলতানের নজরে এলো, একটি কাফেলা দূরের পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে অতিক্রম করছে। সুলতান তখন সঙ্গী এক আমিরকে নির্দেশ দিলেন, যান তো! ওই কাফেলাটা থামান। তাদের জিজ্ঞেস করুন, কোন শহর থেকে আসছে।
আমির গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। ফিরে এসে জানালেন, রেই শহর থেকে আসছে কাফেলা। সুলতান জানতে চাইলেন, তাদের গন্তুব্য কোথায়? কোন শহরে যাবে? আমির এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। সুলতান আরেক আমিরকে বললেন, আপনি যান তো! জিজ্ঞাসা করুন, কাফেলা কোথায় যাবে। আমির ফিরে এসে জানালেন, কাফেলাটি ইয়ামেনের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সুলতান জানতে চাইলেন, কোন ধরনের পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে? আমির হতভম্ব, কোনো জবাব দিতে পারলেন না। সুলতান আরেকজন রইসকে বললেন, যান তো, জেনে আসুন, তারা কি পণ্য নিয়ে ইয়ামেন যাচ্ছে? আমির ফিরে এসে জানালেন, জাঁহাপনা, রেই শহরে নির্মিত বাসন-কোসন নিয়ে যাচ্ছে। কাফেলা কোন সময় রেই শহর থেকে রওনা দিয়েছে- সুলতান মাহমুদের জিজ্ঞাসা। কিন্তু আত্মভোলা আমির জবাব দিতে পারলেন না। এভাবে একে একে ৩০ জন আমির-রইসকে সুলতান মাহমুদ গজনভি জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তাতে পরীক্ষায় সবার দুর্বলতা হাতে- নাতে প্রমাণিত হলো। এবার সুলতান সবাইকে জড়ো করে বললেন,
গোফত আমিরান রা কে মন রুজি জুদা
এমতেহান কর্দম আয়াজে খেশ রা
বললেন আমিরদের- একদিন আমি পৃথকভাবে
পরীক্ষা করলাম আমার আয়াজকে ডেকে।
কে বেপোর্স আজ কারোয়ান তা আজ কুজাস্ত
উ বেরাফত ইন জুমলা ওয়াপুরসিদ রাস্ত
কাফেলার কাছে জিজ্ঞেস কর কোত্থেকে তারা আসে
গিয়ে সে এসব কিছু জিজ্ঞাসা করল ঠিকঠিকভাবে।
হার চে জিন সি মির আন্দর সি মকাম
কশফ শুদ জু আন বে য়্যকদম শুদ তামাম
৩০ জন আমির যে তথ্য যোগাড় করলেন ত্রিশবার গিয়ে
একবারে আয়াজ উদ্ঘাটন করল সব তথ্য নির্ভুলভাবে।
হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়ার পরও আমিররা দমবার পাত্র নয়। নিজেদের সাফাই গাইতে তারা আশ্রয় নিলেন জবরিয়া মতবাদের। বললেন, জাঁহাপনা, আয়াজের এই বুুদ্ধিমত্তা তো নিজের অর্জিত নয়। সে পেয়েছে জন্মগতভাবে খোদাপ্রদত্ত্ব। কাজেই তাতে তার কীসের কৃতিত্ব। কেন সে ত্রিশজনের বেতন-ভাতা নেবে, আলাদা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাবে?
তারা বুঝতে চাইল না, বিশ্বব্যবস্থায় কেউ বেশি কেউ কম পাওয়ার যে তারতম্য আমরা দেখি, তার রহস্যও এখানেই লুক্কায়িত। তাই তারা জোরালো যুক্তি সাজাল, চাঁদের চেহারায় রূপ মাধুরি আল্লাহর দেওয়া। ফুলের প্রাণকাড়া সুবাস সৃষ্টিগত। তাই রূপমাধুরী ও প্রাণকাড়া সুবাস চাঁদ বা ফুলের নিজস্ব কৃতিত্ব হতে পারে না। তাতে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ হয় না। মানুষের জীবনও ব্যতিক্রম নয়। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে যে যোগ্যতা প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তার বাইরে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। মানবজীবনের মূল সুর ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ।’
বিদ্ঘুটে এই যুক্তিদর্শনের কথা শুনে সুলতান আমিরদের ভুল শোধরানোর উদ্যোগ নিলেন। বললেন, আপনারা যে ধারণা পোষণ করছেন, তা সঠিক নয়। মানুষের জীবন প্রণালী দুই অবস্থার বাইরে নয়। মানুষ হয়তো তার অলসতা অবহেলার ভোগান্তি পোহায়। অথবা চেষ্টা ও সাধনার ফসল ঘরে তোলে। কাজেই মানুষ বাধ্য বা নিয়তির নিগঢ়ে আবদ্ধ নয়। দুই অবস্থার যে কোনো একটি গ্রহণ করার ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যদি তার কাজকর্মের ব্যাপারে তকদিরের লিখনের বাধ্য হতো, তাহলে কি আদম (আ.) বলতেন, ‘প্রভু হে, আমি আমার প্রতি জুলুম করেছি। তিনি তো শয়তান যে ভাষায় বলেছে, সে ভাষায় বলতে পারতেন, আমার তকদিরে লেখা আছে- তাই গান্দুম খেয়েছি। কাজেই আপনাদের যুক্তিদর্শন সঠিক নয়।
ওয়ার না আদম কেই বেগুফতি বা খোদা
রব্বানা ইন্না জালামনা নাফসানা
নচেত আদম কি বলতেন আল্লাহর কাছে আর্জিতে
প্রভু হে, আমরা জুলুম করেছি নিজেদের প্রতি নিজে।
জবরি মতবাদ সঠিক হলে আদম (আ.) সরাসরি বলতেন, আমি যে গুনাহ করেছি তা আমার কপালের লিখন ছিল। ভাগ্যের লিখনের বাইরে নিজস্ব বিচক্ষণতা দেখানোর সুযোগ ছিল না আমার। ইবলিস যে যুক্তি দিয়েছে সে যুক্তি তিনিও দিতেন। বলতেন, গান্দুম খাওয়ার জন্য আমি দায়ী নই। আদমকে সেজদা না করার দায়ে অভিযুক্ত হলে ইবলিস দায়টা চাপিয়েছিল স্বয়ং আল্লাহর ওপর।
হামচো ইবলিসসি কে গোফত আগ ওয়াইতানি
তো শেকাস্তি জাম ও মারামি জনি
ইবলিস যেমন বলেছিল, পথভ্রষ্ট করেছ আমায় তুমি
তুমিই ভেঙেছ জামবাটি তারপর মারছ আমায় ধরি।
শয়তান ভাগ্যকে দায়ী করে বলেছিল, হে আল্লাহ, তুমিই তো আমাকে পথভ্রষ্ট করেছ। আমার হাতের জামবাটি তুমি নিয়ে ভেঙে ফেলেছ, আবার এর জন্য আমাকে মারধর করছ। পবিত্র কোরআন এরশাদ হয়েছে- ‘সে বলল, হে আমার প্রতিপালক, আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন তার জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপকর্মকে অবশ্যই শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সবাইকে বিপদগামী করে ছাড়ব।’ (সুরা হিজর : ৩৯)।
সাবধান! ইবলিসের মতাদর্শী হইও না। মনে দৃঢ় বিশ্বাস রাখো,
বল কাজা হক্কাস্ত ও জাহদে বন্দা হক
হিন মবাশ আওয়ার চো ইবলিসে খলক
বরং ভাগ্যলিপি সত্য বান্দার চেষ্টাও জানো সত্য
সাবধান, শয়তানের মতো হয়ো না কানাচোখ তুচ্ছ। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৪০৭)
ইবলিস কানাচোখ ছিল। তাই সে একদিক দেখেছে। নিয়তির বাধ্যতার বিষয়টিই দেখতে পেয়েছে। মানুষকে দেওয়া ভালো-মন্দের একটিকে বাছাই করার এখতেয়ার সে দেখেনি। অপরদিকে সে আদমের শরীর দেখেছে, মাটির মানুষ মনে করেছে। শরীরের ভেতরে বিরাজিত আদমের বিশাল ব্যক্তিত্ব সে দেখেনি। কানাচোখ ইবলিসের অনুসারীরাও মনে করে, ভাগ্যের লিখনের কাছে মানুষ বাধ্য। যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ। মানুষকে দেওয়া কর্মস্বাধীনতা তারা দেখে না।
এই দর্শনের ভ্রান্তি বুঝার জন্য তোমার একটি মানসিক অবস্থাকে বিবেচনায় নাও। কোনো সময় কি তোমাকে দুটি কাজের কোনটি করব কোনটি করব না- এমন প্রশ্ন নিয়ে সন্দেহে ভুগতে হয়েছে? পরে একটিকে গ্রহণ করে অন্যটি বর্জন করেছ? বল, এমন দুদোল্যমানতা কেন সম্ভব হলো। মানুষ যদি নিয়তির লিখন অনুযায়ী কাজ করতে বধ্য হয়, তাহলে তো একাধিক বিষয় নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ে ভোগার সুযোগ নেই। অসম্ভব বিষয় নিয়ে তো মানুষ সন্দেহ পোষণ করে না। যেমন, কোনো মাধ্যম ছাড়া সাগর বুকে ডুব দেওয়া বা আকাশে উড়াল দেওয়া। এ কাজ করবে কি করবে না তা নিয়ে কেউ কখনও সন্দেহ সংশয়ে ভোগে না। কারণ, সে জানে ওই দুটি কাজ করার এখতেয়ার মানুষকে দেওয়া হয়নি। তুমি যে বল, একাজ করব, ওকাজ করব না, নিয়তির বাধ্য হলে এমন কথা বলা তো তোমার শোভা পায় না। কারণ তোমার মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষের তো কোনো কাজ করার বা না করার কিংবা বাছাই করার ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নেই।
আসল ব্যাপার হচ্ছে, মানুষকে দুটি বা একাধিক বিষয়ের একটিকে গ্রহণ করে অন্যটি বর্জন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ জন্যেই তুমি বলতে পার, সফরে গেলে আমি অমুক শহরে যাব, অমুক শহরে যাব না। অতএব, ভাগ্যলিপি ওপর দোষ চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করো না। বরং যেটি সত্য ও শ্বাশ্বত তা মেনে নিয়েই জীবনকে সাজাও।
বর কজা কম নেহ বাহানে আই জওয়ান
জুর্মে খোদ রা চোন জনি বর দিগরান
ভাগ্যের অজুহাত দেখিওনা হে যুবক অযথা
নিজের দোষ কেন চাপাও অন্যের ঘাড়ে বলা তা। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৪১৩)
গেরদে খোদ বরগার্দ ও জুরমে খেশ বেবিন
জুম্বিশ আজ খোদ বিন ও আজ সায়ে মবিন
নিজের কাছে ফিরে এসো দেখ নিজের দোষ
তৎপরতা তোমার নিজের পুুতুলের নাচন নয়। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৪১৫)
তোমার কর্মতৎরতা তোমার থেকেই উৎসারিত। ছায়া যেমন আসলের অনুগামী হয়। মনে করো না যে, তোমার কাজকর্ম ছায়ার মতো বাধ্যগত বা পুতুলের নাচের মতো। আর আল্লাহ বিচার না করে প্রতিফল দেবেন।
কে নখাহাদ শুদ গালাত পাদাশে মির
খসম রা মি দানদ আন মিরে বসির
কারণ বাদশাহ ভুল করে কাউকে দেবেন না পুরষ্কার
তিনি সর্বদর্শী দেখেন কে আপন, কে দুশমন তার।
জুর্ম বর খোদ নেহ বে তো খোদ কাশতি
বা জজা ও আদলে হক কুন আশতি
দোষ গুনাহ নিজের কাঁধে নাও, তুমিই তো চাষ করেছ
আল্লাহর বিচার ও প্রতিফলের সঙ্গে আত্মীয় হয়ে যাও।
তোমার কৃতকর্মের দায় নিজেই নাও। আল্লাহ ন্যায়বিচারক, তার প্রতিদানের বিধানে বিশ্বাসী হয়ে সুন্দর জীবন গড়ে তোলো।
তাওবা কুন মর্দানা সর আওয়ার বেরাহ
কে ফামাঁই য়ামাল বেমিস্ কালিন য়ারাহ
তওবা করো সাহসী পুরুষরূপে এসো হেদায়তের পথে
অনুপরিমাণ আমল যে করবে তার প্রতিফল অবশ্যই পাবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৬খ. বয়েত-৩৮৫-৪৩৪)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)