ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মৃতপ্রায় শ্যামাসুন্দরী খাল, ১৫০ কোটি টাকা খরচেও মেলেনি সুফল

প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৮ কোটির বেশি
মৃতপ্রায় শ্যামাসুন্দরী খাল, ১৫০ কোটি টাকা খরচেও মেলেনি সুফল

রংপুর শহরের বুকে প্রবাহিত প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো শ্যামাসুন্দরী খালটি আজ মৃতপ্রায়। এক সময়ের স্বচ্ছজলধারা এখন দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনায় হয়ে উঠেছে দুর্গন্ধময় জলাধার। গত দুই দশকে খাল রক্ষায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এবার নতুন করে আরও ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু এত অর্থ ব্যয় করেও মেলেনি কোনো কার্যকর সুফল—এই প্রশ্নই ঘুরছে নগরবাসীর মুখে মুখে।

শ্যামাসুন্দরী খাল রক্ষায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই হয়েছে অকার্যকর। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও জনসচেতনতাহীনতার কারণে খালটি হয়ে উঠেছে ময়লার ভাগাড়। দুই পাশে অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ ও দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে খালটি হারিয়েছে নাব্যতা।

সরেজমিন দেখা গেছে, পানির প্রবাহ না থাকায় খালপাড়জুড়ে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। মশা-মাছির উপদ্রব অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। খালপাড়ের অনেকেই দুঃসহ পরিবেশের কারণে বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

নগরবাসীর অভিযোগ, পৌরসভা থেকে রংপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার দেড় দশক পার হলেও শ্যামাসুন্দরী খালের ভাগ্য বদলায়নি। একসময় যে খাল নগরীর সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল, সেটিই এখন দখল-দূষণের কারণে রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত খাল সংস্কারে ব্যয় হয় ১২৫ কোটি টাকা। এরপর সাবেক মেয়র মোস্তফিজার রহমান মোস্তফা আরও ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন করে আবারও পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার আওতায় খাল পরিষ্কার ও দুপাশে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে এ প্রকল্প নিয়েও রয়েছে সংশয়। রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, "সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো প্রকল্পই কার্যকর হবে না। খাল রক্ষায় শুধু সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা জেলা প্রশাসন একা সফল হতে পারবে না। পরিবেশ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের অংশগ্রহণে সমন্বিত একটি টেকসই প্রকল্প নিতে হবে।"

তিনি আরও বলেন, "ঘাঘট নদ থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করায় খালটির স্বাভাবিক স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে। খাল রক্ষায় প্রথমে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ বন্ধ ও বিজ্ঞানভিত্তিক পুনঃখনন জরুরি।"

রংপুর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "আমরা খালটি শুধু পরিষ্কার করে থাকি। বরাদ্দ কম থাকায় নিয়মিত সংস্কার সম্ভব হয় না। এই খাল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রকল্প প্রয়োজন। ছোট ছোট প্রকল্প দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।"

তিনি আরও জানান, ২০২০ ও ২০২১ সালে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই রংপুর শহর প্লাবিত হয়েছিল, যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শ্যামাসুন্দরীর অপ্রবাহযোগ্যতা।

প্রসঙ্গত, জলাবদ্ধতা ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৮৯০ সালে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বলভ সেন তার মা শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি পুনঃখনন করান। খালটির প্রস্থ ছিল এলাকাভেদে ২৩ থেকে ৯০ ফুট পর্যন্ত। বর্তমানে খালটির অবস্থান কেলাবন্দ থেকে শুরু হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘট নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।

তবে এখন শ্যামাসুন্দরী খাল শুধু ইতিহাস নয়, এক চরম অব্যবস্থাপনারও প্রতিচ্ছবি। যদি দ্রুত, কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতেই রংপুরবাসীর জীবনব্যবস্থা এক ভয়াবহ জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে পারে—এই আশঙ্কাই করছেন সচেতন মহল।

শ্যামাসুন্দরী খাল
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত