ঢাকা মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মা আমার পরশ পাথর

আসাদ সরকার
মা আমার পরশ পাথর

আমার মা আমার প্রথম স্কুল। আমার মা আমার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মহা বিদ্যালয়। আমার মা আমার প্রথম শিক্ষক। আমার মা আমার আদর্শ, এক মাত্র অনুপ্রেরণা, আমার ইচ্ছা শক্তি আমার সাহস। মা শব্দটি শুনলে আমার হৃদয়ে একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয় যা পৃথিবীর কোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করলেও সেই অনুভূতি বোঝানো সম্ভব নয়। আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর শব্দটি হচ্ছে মা। আমার জীবনে প্রথম যে শব্দটি শিখেছি সে শব্দটি আমার মায়ের কাছ থেকে। পৃথিবীতে আমরা হয়তো অনেকেই পরশ পাথরের কথা শুনেছি কিন্তু কেউ কি কখনও ধরে অনুভব করছেন? বা নিজের চোখে পরশ পাথর দেখেছি? আমি সত্যি পরশ পাথর দেখেছি? আমার পরশ পাথরের নাম শান্তির পরশ। আর সেই পরশ পাথরটি আমার মমতাময়ী মা। আজকে আমি পৃথিবীতে একজন বড় সফল মানুষ, এই সফলতার আড়ালে একটি গল্প লুকিয়ে আছে। আর সফলতার গল্পটি আমার জনম দুঃখী মা। আমার পরিবার একটি মধ্যেবিত্ত পরিবার। আমাদের পরিবারের আমার দুই চাচা, দাদা, দাদিকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার। আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমার বাবা মারা যায়। পরিবারের নেমে আসে দুঃখের ছায়া। আমার ছয় বছর বয়সে দুই চাচা পরিবার নিয়ে শহরে বসবাস করতে থাকেন। আমি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই। ৫ম শ্রেণি পযর্ন্ত চাচারা ভালো খোঁজ খবর নিতো। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পরে আমার দাদা মারা জান। কিছুদিন পর মেঝো চাচা বাড়িতে এসে দাদিকে নিয়ে যায় শহরে। তারপর থেকে আমাদের সঙ্গে দুই চাচার পরিবারের আর কোন যোগাযোগ নেই। আমার পড়াশোনার খরচ দিন দিন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মা টিউশনি আর সেলাই কাজ করতে থাকেন। কোনো ঈদে মাকে ভালো কাপড় পড়তে দেখিনি। একটি ভালো কাপড় আলমারিতে তুলে রাখতো সেটা আমার স্কুলের কোন প্রয়োজন হলে পড়ে যেতেন। মাঝে মাঝে চোখে পরতো চার পাঁচ তালি যুক্ত কাপড় পড়ে থাকতো। এসব দেখার পরে ইচ্ছে হতো পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লেগে যাই। মায়ের কাছে যখন বলতাম মা, আমার পড়াশোনা আর ভালো লাগে না। মা আমাকে আদর করে বুকে নিয়ে অনেক অনুপ্রেরণা দিতেন। তোমাকে অবশ্যই তোমার চাচাদের থেকে অনেক বড় হতে হবে। শহরে বাড়ি করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে। এভাবে যখন ভেঙে পরতাম তখনি তিনি সাহস দিতেন।

আমি কখনও প্রাইভেট পড়িনি মায়ের কাছে শিখতাম। মা ছেলে কষ্টের জীবনযাপনের মধ্যে শেষ হলো হাইস্কুল এবং আমার এসএসসি পরীক্ষায় ভালো একটি রেজাল্ট হয়। আমার মায়ের ইচ্ছে শহরে ভালো কলেজে পড়াবে। কিন্তু আমি বুঝি মায়ের অনেক কষ্ট হবে। তাই বায়না ধরলাম আমি শহরে যাবো না। অনেক বায়না ধরলাম কিন্তু মাকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। একদিন মা এবং আমি শহরের বড় চাচার বাসায় গেলাম আমার রেজাল্ট জানানোর জন্য কিন্তু চাচার এবং চাচির ব্যবহার দেখে মনে হলো আমরা ওদের বাড়ির চাকর। তারপরও মা বড় চাচাকে বললো ভাইজান শাকিবকে শহরের সরকারি কলেজে পড়াতে চাচ্ছি? যদি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো তাহলে কষ্ট হতো না।চাচা কিছু বলার আগে চাচি আম্মুকে বললো আমাদের বাসায় তো জায়গা নেই কোনো ম্যাচে তুলে দেন। আমার মা কিছু না বলে চুপচাপ দুটি চোখে জল মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বাহির হয়ে এলেন। আমি এই প্রথম আমার আম্মুকে আমার চোখের সামনে কাঁদতে দেখলাম। আমি মায়ের পা ধরে বললাম মা, আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না। আম্মু আমাকে বুকে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। দুপুরের খাবারের সময় হয়েগেছে। মেঝো চাচার বাসায় যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করলেন। আমি আম্মুকে বললাম, আম্মু আমার একটি কথা রাখবে? কি কথা বল? আগে বলো রাখবে আচ্ছা বল আগে রাখার চেষ্টা করবো, (আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমাকে অনেক বড় হতে হবে) মা মেঝো চাচার বাড়িতে যাব না। চলো বাড়িতে চলে যাই।

আমি কলেজে ভর্তি হয়ে টিউশন করে পড়াশোনার খরচ জোগাব। একটি নরমাল মেসে উঠবো। কোনো চাচার বাসায় উঠে পড়াশোনা করবো না। আমার কথা শুনে মা কিছু সময় ধরে চুপ করে রইল। তারপর থেকে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি সংগ্রাম করা শিখে গেছি। দিনেরাতে দুই বেলা খাওয়ার অভ্যাস করে নিলাম। সেই থেকে আজ পযর্ন্ত আমার দুই বেলা খাওয়ার অভ্যাস। কলেজে ভর্তি হয়ে টিউশন খুঁজতে খুঁজতে কতদিন না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। একদিন রাতে না খেয়ে অনেক পেট ব্যথা। মেসের এক বড় ভাই চিকিৎসার টাকা দিয়ে চিকিৎসা করায়। বড় ভাইয়ের কাছে সবকিছু খুলে বলি। পরের দিন তিনি আমাকে দুই বেলা খাওয়ার বিনিময়ে আমাকে একটি টিউশন ব্যবস্থা করে দেন। আপতত পেটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্ত মেসের ভাড়া কলেজের টিউশন ফি টাকার চিন্তা মাথায় রইয়ে গেল। কিছুদিন পর যাদের বাসায় পড়ায় এই আন্টি আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি লোকলজ্জার কথা চিন্তা না করে সব খুলে বলি। তিনি আমার জন্য একটি টিউশন সংগ্রহ করে দেন। এভাবে কলেজ জীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আজকে এই জায়গায় পৌঁছেছি। তার পিছনে যে মানুষ তার জীবন যৌবন নষ্ট করেছেন তিনি আমার মা। যিনি চাইলে আমাকে ছেড়ে ভালো একটি ছেলের সঙ্গে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারতেন তিনি আমার মা। আজকে এই শহরে দুটি পাঁচ তলা বাড়ি বিশাল ব্যবসা সব কিছু আমার আম্মুর জন্য। আমার মায়ের নামে যতটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো লোকসান নেই। কারণ তিনি আমার পরশ পাথর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত