“আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।/ পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,/ একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।” (আমাদের গ্রাম-বন্দে আলী মিয়া)।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বন্দে আলী মিয়া ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তাঁর কবিতায় পল্লী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তিনি ছিলেন নিপুণ কারিগর। তিনি শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় চিত্রকর ও ব্লক কোম্পানির ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ আজও অমর হয়ে আছে। জন্ম ১৭ জানুয়ারি ১৯০৬ সালে পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। পিতার নাম মুন্সী উমেদ আলী। তিনি পাবনার মজুমদার একাডেমি থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন এবং ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে। দেশ বিভাগের পর কলকাতার জীবনে সান্নিধ্য লাভ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের । কলকাতা জীবনে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ২০০টি। বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানীতে তাঁর রচিত পালাগান ও নাটিকার রের্কড। বন্দে আলী মিয়া প্রথমে ঢাকা বেতারে চাকরি করেন ১৯৪৬ সালের পর। ১৯২৫ সালে তিনি সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ইসলাম দর্শন পত্রিকায়। তাঁর রচিত ’ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। তাঁর ‘অনুরাগ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। ‘পদ্মানদীর চর’ ও ’ধরিত্রী’ তাঁর কাব্যগ্রন্থ। ’মধুমতীর চর’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ‘শেষ লগ্ন’ ১৯৪১ সালে। বন্দে আলী মিয়া রচিত বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘অরণ্য’ ‘গোধূলী’ ‘ঝড়ের সংকেত’ ‘নীড়ভ্রষ্ট’ ‘জীবনের দিনগুলো’ ’বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ ‘অরণ্য গোধূলি’ (১৯৪৯) প্রভৃতি। তার গল্প গ্রন্থ ’তাসের ঘর’ ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। ‘মসনদ’ তার রচিত নাটক সম্পাদিত হয় ১৯৩১ সালে।
’কুঁচবরণ কন্যা’ তার শিশুতোষ গ্রন্থ, ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত কয়েকটি শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘চোর জামাই’ ‘মেঘকুমারী’ ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ ‘মৃগপরী’ ‘বোকা জামাই’ ‘সোনার হরিণ’, ‘শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা’ ‘ডাইনী বউ’ ‘রূপকথা’ ‘সাত রাজ্যের গল্প’ ‘হাদিসের গল্প’ প্রভৃতি। বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের গ্রাম’ এর লেখক বন্দে আলী মিয়া। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে। তাঁর অন্যান্য পুরস্কারগুলো হলো, ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ (১৯৬৫) এবং উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক’ (১৯৭৭) লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স’ পুরস্কার লাভ করেন সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদারের জন্য। কবি মরণোত্তর ’একুশে পদকে’ ভূষিত হন ১৯৮৮ সালে। বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি, গণমানুষের কবি বন্দে আলী মিয়া। অসংখ্য কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি। মা-মাটি-মানুষের প্রতি দরদ ফুটে উঠেছে তার সৃষ্টিকর্মে। গ্রাম নিয়ে তার অমর কবিতা ‘আমাদের গ্রাম’ পড়লে পাঠককে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে শৈশবে, যেখানে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
অমর কথাসাহিত্যিক কবি বন্দে আলী মিয়া। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ একাধিক বিষয়ে বই লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যসেবায় তাঁর অনন্য প্রয়াস সার্থক করেছে বাংলাকে। তার রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে। তবু তিনি বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন। রাজশাহীতে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন।