ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

লনিয়া বলল, ‘তোমাদের একজন ফায়ারউড সংগ্রহ করো। পাইন গাছের শুকনো ডাল কেটে আনো। খুব বড় নয়, সাত-আট ইঞ্চি পরিমাণের টুকরো করলেই চলবে। তাপমাত্রা রাতে আরও নামবে, তাই আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি থাকতে হবে। অন্যজন পরিষ্কার তুষার সংগ্রহ করে একটা পাত্রে রাখো; বরফ গলিয়ে পানযোগ্য পানি বানাতে হবে। কাজগুলো শেষ করে তারপর তাঁবু খাটাতে আমাকে সাহায্য করো। বিশেষ করে অন্ধকার নামলে কাটাকাটির কাজ করা আর সম্ভব হবে না, তাই এখনই কাজগুলো শেষ করে ফেলতে হবে আমাদের।’

গালিব স্বস্তি নিয়ে বলল, ‘সমস্যা নেই আগুন জ্বালিয়ে কাজ করলে খানিকটা আনন্দও পাবো।’

লনিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আনন্দের চিন্তা পরে, আগে থাকার জায়গাটা ঠিক করো; পরে আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার সুযোগ পাবে। মনে রেখো রাত যত গভীর হবে ঠান্ডার প্রকোপও বাড়বে। হাত-পা অবশ হয়ে আসবে, কাজ করতে পারবে না।’ লনিয়ার কণ্ঠে আদেশের সুর শুনে দুজন বুঝে গেল বিলম্বের কোন সুযোগ নেই।

গবেষকদের কাজকর্ম ভাগ করে দিয়ে লনিয়া নিরাপদ জায়গা নির্বাচন করে তাঁবু টানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পর্বতের গায়ে হলেও জায়গাটা মোটামুটি সমতল আর নিরাপদ। এখানে তাঁবু খাটালে বিপদের সম্ভাবনা নেই, সেটাও জানালো লনিয়া। তাঁবু আর অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্যান্ডসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু তাদের সঙ্গেই আছে। খাবার-দাবারের জন্যেও টেনশন নেই; শুকনো খাবারও সঙ্গে আছে। এছাড়াও কিছু প্যাকেটজাত মাছ নিয়ে এসেছে। বৈকাল স্টেশনের সুপার শপ থেকে ‘ওমুল’ মাছ কিনেছে। মাছগুলো জুনের শেষ নাগাদ পর্যন্ত ফ্রিজ হয়ে থাকবে। খাবার সংকট দেখা দিলেই তবে ফিশফ্রাই খাবে। এর আগে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করবে। লনিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে সে। প্রয়োজনে আদিবাসীদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করবে। পর্বতের নিচের দিকে হলে খাদ্যের তেমন সমস্যা হতো না। বিশেষ করে বরফাবৃত জলাশয়গুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। অন্যান্য সাইবেরিয়ানদের মতো বরফ খুঁড়ে মাছ শিকার করতে পারতো বলে জানিয়েছে লনিয়া। কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়; পর্বতের উপরে সেই ধরনের সুযোগ নেই।

আধঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে লনিয়া তুষার সরিয়ে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে ফেলল ছোট বেলচাটা দিয়ে। তারপর দেখতে দেখতেই সুন্দর একটা তাঁবু বানিয়ে ফেলল লনিয়া।

গালিবও বসে নেই। পাইন গাছের শুকনো ডাল কেটে টুকরো টুকরো করে তাঁবুর সামনে এনে জড়ো করল। সোপান পরিষ্কার তুষার সংগ্রহ করে একটা পাত্রে রাখল। লনিয়ার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় আছে দুজন। লনিয়া গাইড হলেও এখন দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছে সে। কারণ গবেষকদের সাইবেরিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁবু খাটিয়ে টিকে থাকার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে লনিয়া। অবশ্য এছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই তাদের। দুজনকে বাধ্য হয়েই লনিয়ার ওপর নির্ভর হতে হয়েছে।

তাঁবু খাটিয়ে প্রথমে ফায়ারপ্লেসটা ঠিকঠাক করে ফেলল লনিয়া। ঠান্ডায় ওদের শরীর জমে আসছে, ফায়ারপ্লেসে এখুনি কাঠ না ফেললে বিপদে পড়বে। তাপমাত্রা আয়ত্তে আনতে হবে। তাই দ্রুত তাঁবু গরম করার ব্যবস্থা করল লনিয়া।

অল্প সময়ের মধ্যে তাঁবুর কাজসম্পন্ন করা হলো। তাঁবুটা সাইজে ছোট, দুজনের জন্য উপযোগী হলেও তিনজনের জন্য গাদাগাদি হবে। আসলে গবেষকরা আগে বুঝতে পারেনি, তাই তাদের দুজনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি এনেছে। গাইডের বাসস্থানের জন্য তখন ওভাবে চিন্তাভাবনা করেনি তারা। আজ রাতটা গাদাগাদি করেই কাটাতে হবে। অবশ্য তাতে সমস্যা হবে না, বরং গাদাগাদির কারণে তাঁবুতে উষ্ণতা বাড়বে। আগামীকাল আদিবাসীদের সন্ধান পেলে ওদের সঙ্গে লনিয়ার থাকার ব্যবস্থা করে দেবে কিছু অর্থকড়ির বিনিময়ে।

সবকিছু ঠিকঠাক করেই তাঁবুর ভেতরে তিনজন আশ্রয় নিয়েছে। আপাতত আর কোন কাজকর্ম নেই আজ। খাওয়া-দাওয়া, তারপর দীর্ঘ ঘুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মালভূমির দিকে যাত্রা করবে; এ হচ্ছে লনিয়ার পরিকল্পনা। অবশ্য লনিয়া গবেষকদের সঙ্গে তার পরিকল্পনাটা শেয়ার করেও নিয়েছে।

এদিকে রাতের আঁধার নেমে এসেছে। ধীরে ধীরে তাঁবু গরম হচ্ছে। তাঁবুর ভেতরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। আরামবোধ করছে সবাই এখন। লনিয়া এরই মধ্যে খাবার প্রস্তুত করে ফেলল। ডিমণ্ডসবজি-পাউরুটি রাতের খাবার। এই ফাঁকে গালিব বানিয়ে ফেলেছে পাইন পাতার চা।

খেয়েদেয়ে তিনজন কিছু সময় গল্প করে শোয়ে পড়ল। অল্প সময়ের মধ্যে লনিয়া ঘুমিয়ে পড়ল। গবেষকদের চোখে ঘুম নেই। অজানা আশঙ্কায় তাদের বুক ধড়ফড় করছে। যদিও এতদঞ্চলে দুর্বৃত্তদের নিয়ে ভয়-টয় নেই, তবে হিংস্র জানোয়ারের উপদ্রব একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চিতা, বাদামি ভালুক আর নেকড়ের পাল তাদের অবস্থান টের পেয়ে যদি একবার শিকারের টার্গেট করে ফেলে, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিনই হবে। ভরসা হচ্ছে তাঁবুর ভেতর ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। আগুনের শিখা নজরে পড়লে হয়তো হিংস্র পশুরা এদিকে আসবে না। কিন্তু সেটা বড়জোর ঘন্টাদুয়েক। কারণ ততক্ষণে তুষারে তাঁবু ঢেকে যাবে। বাইরে থেকে আগুনের শিখা নজরে পড়বে না তখন আর। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গেলে বিপদ এড়ানো কঠিনই হবে। বড়সড়ো তাঁবু হলে সেই কাজটা ভেতরে সেরে ফেলা যেত। ছোট তাঁবুতে পোর্টেবল টয়লেট ব্যবহার করাটা অস্বস্তিকর লাগবে।

লনিয়া বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকার আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে সোপান বলল, ‘দেখো ব্যাটার কোন ভয়-ডর নাই। না আছে হিংস্র পশুদের ভয়, না আছে অপরিচিত দুজনকে নিয়ে শঙ্কা।’

গালিব বলল, ‘বিষয়টা সেখানে নয়। তারা জন্মলগ্ন থেকে এই পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। এখানকার ঠান্ডা বা হিংস্র প্রাণীর ভয়ে ভীত নয়। এরা যেমন ঠান্ডা সইতে পারে, তেমনি হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে মোকাবিলা করার কৌশল জানে। তাছাড়া মানুষজনকেও সহজে বিশ্বাস করে। যতটা জেনেছি সাইবেরিয়ার মানুষ অতটা হিংস্র বা প্রতারক নয়; তাই আমাদের নিয়ে তার ভয়-ডর নেই।’

‘ঘোড়ার ডিম জানো তুমি। লনিয়া কী এমন পালোয়ান যে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ ঠেকিয়ে দিতে পারবে।’

‘আরে ভাই, আমি বুঝিয়েছি কৌশল জানে। যেমন ধরো তাঁবুটা এমন জায়গায় খাটিয়েছে, যেখানে নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হবে না বা হিংস্র প্রাণীদের আনাগোনা নেই।’

‘তুমি তো দেখছি সবই জানো। কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, দ্রুত ঘুম থেকে উঠতে হবে।’

‘ঘুম আসছে না বন্ধু। সত্যি বলতে, ভয় লাগছে আমার।’

‘এই জন্যই আবোল তাবোল বকছো। এখন বলো ভয়টা কিসের!’

‘প্রথমত হিংস্র প্রাণী; আর ভূত-প্রেতের বিষয়টাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ভয়ে তাই গা ছমছম করছে।’ ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৯) চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত