ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

নাটালিয়ার পরামর্শ শুনে উপাল খুব খুশি হলো। প্রবল আবেগ নিয়ে বলল, ‘তোমার জানানো সব তথ্য আমাদের ভ্রমণে সহায়ক হবে। আমরা তুন্দ্রার সীমানায় পা রেখেই ফিরে আসব। রাত কাটানোর চিন্তা করছি না আপাতত। শুধু কৌতুহল নিবারণ করব, বলতে পারো তুন্দ্রার সৌন্দর্যটা স্বচক্ষে দেখেই ইয়াকুস্কে ফিরে আসবো।’

নাটালিয়া বলল, ‘এই হোটেলে ট্যুরিস্টদের নিয়ে কিছু জিপ গাড়ি প্রায়ই আসে। চালকদের একজনের সঙ্গে আমার ভালো খাতির আছে। তার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাবো তোমাদেরকে। তবে বড়ো একটা জিপ ভাড়া করে দেওয়ার ইচ্ছে আমার। তাতে খানিকটা সুবিধা হবে। তুন্দ্রায় ট্যুরিস্টদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি যাতায়াতে বিলম্ব হয়, তাহলে গাড়িতেই বিশ্রাম নিতে পারবে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখে, সিটে হেলান দিয়েই সময় পার করে দিতে পারবে। তাছাড়া গাড়ির ভেতরে বসে থাকলে শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

উপাল বলল, ‘তোমার পরিকল্পনাটা শুনে ভালো লাগলো। তাহলে বড়সড়ো একটা গাড়ি ভাড়া করে দাও। উপযুক্ত ভাড়াই পরিশোধ করব আমরা।’ নাটালিয়ার সঙ্গে কথা পাকাপাকি করে দুজন রুমে চলে এসেছে। তুন্দ্রা ভ্রমণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে তারা। এদিকে নাটালিয়া তার পরিচিত জিপ চালক আন্দ্রে দানিয়া-র সঙ্গে কথা বলে দিনক্ষণ পাকাপাকি করে ফেলেছে। তাকে বলেছে, ‘ভোরে এসে ট্যুরিস্টদেরকে হোটেল থেকে নিয়ে যেও। ভাড়া নিয়ে চিন্তা করো না; ভাড়া বেশিই পাবে। তুমি শুধু জ্বালানির হিসাবটা মনে রাখলেই হবে।’

রাত ১০টার দিকে নাটালিয়া পর্যটকদের জানিয়েছে, সকাল ৯টায় হোটেলের সামনে গাড়ি চলে আসবে। সংবাদটা শুনে দুজন ভীষণ আবেগ আপ্লুত হলো। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছগাছ করে ব্যাগে রাখল; সঙ্গে বড় সাইজের একটা কম্বলও নিলো তারা। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কম্বলটা বেশ কাজে দেবে। রাতে তাদের ভালো ঘুম হয়নি। চোখের সামনে ভাসছে শুধু তুন্দ্রার হিমশৈলের দৃশ্য। ফলে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই বাকিটা রাত পার করতে হলো তাদের। সকাল হতেই প্রাকৃতিক কাজকর্ম সম্পন্ন করে দুজন জিনিসপত্র নিয়ে হোটেলের নিচে নামল। গাড়ি প্রস্তুত। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে ফেলল আন্দ্রে।

আন্দ্রে দানিয়া ইয়াকুটস্কের স্থায়ী বাসিন্দা। মধ্যবয়স্ক। অন্যান্য ইয়াকুতিয়ানদের মতোই তার চেহারা, আকার-আকৃতি। প্রথম দেখাই বোঝা যাচ্ছে লোকটি উপকারী স্বভাবের। দীর্ঘ যাত্রায় তার সাহচর্য ভালোই কাটবে। জিনিসপত্র গাড়িতে উঠিয়ে আন্দ্রে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি শুকনো খাবার নিয়েছ? না নিলে বিপদে পড়বে; এখুনি কিনে আনো।’ সোপান হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘সকাল সকাল কি দোকানপাট খোলা পাবো?’

‘পশ্চিম দিকের রাস্তায় একটা সুপার শপ খোলা আছে। চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে, ইচ্ছে করলে ওখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারো। তোমরা খাবার সংগ্রহ করো, এই ফাঁকে আমি বাড়তি জ্বালানি সংগ্রহ করছি।’ আন্দ্রে দানিয়ার পরামর্শে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুপার শপ থেকে সংগ্রহ করে তারা গাড়িতে উঠে বসল। যাতায়াতে প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা সময় লাগবে; তাই বাড়তি জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হচ্ছে তাদের। তাছাড়া দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুন্দ্রায় আজ থেকে যাবে; প্রয়োজনে গাড়িতেই রাত কাটাবে। অবশ্য তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়টা চালককে এখনও জানানো হয়নি।

টুকিটাকি কাজ সেরে আন্দ্রে দানিয়া গাড়ির স্টিয়ারিং সিটে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগেই আন্দ্রে ইয়াকুটস্কের আবহাওয়া সম্পর্কে পর্যটকদের সামান্য ধারণা দিলো, ‘তোমরা ভালো সময়ে ইয়াকুটস্কে এসেছ। সাখা রাজ্যে এখন বসন্তকাল; দিনের দৈর্ঘ্য ধীরে ধীরে বাড়ছে। আরেকটি কথা তোমাদের জানা নেই হয়তো, গ্রীষ্মে সাখা রাজ্যের দিনের দৈর্ঘ্য অনেক বেড়ে যায়; প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো সূর্যের আলো থাকে। শীতে দিনের দৈর্ঘ্য একেবারে কমে আসে; বড়জোর ৩-৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো দেখা যায়। মূলত এপ্রিল থেকেই দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। এই বাড়তি সময়টা আজ তোমাদের বেশ কাজে লাগবে।’ আন্দ্রে দানিয়ার কথা শুনে ট্যুরিস্টদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তারা মনে মনে ভরসা পেলো; যাক ভালো সময়েই তুন্দ্রায় যাত্রা করছে।

সুযোগ পেয়ে উপাল সেনানায়েকে আন্দ্রের কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা আমরা কি ইচ্ছে করলে ওখানে রাত কাটাতে পারব?’ ‘এখনই বলা যাচ্ছে না, পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করবে বাকিটা। বিশেষ করে গ্রামে পৌঁছার পর যদি নেনেটদের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তাদের তাঁবুতে থাকতে পারবে। না হলে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।’ নিকোলাস ডি সিলভা আবদার জুড়ে দিলো, ‘থাকার ব্যবস্থাটা করে দিও আন্দ্রে; ইচ্ছে করলেই পারবে তুমি।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে আন্দ্রে বলল, ‘আগে ওখানে পৌঁছাতে দাও; তারপর দেখা যাবে কী করতে পারি। রাস্তায় জমে থাকা তুষারের ঘনত্ব না থাকলে আমরা সময়মতো পৌঁছে যেতে পারব আশা করি।’ সকাল ৯টায় গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে আন্দ্রে। ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে লাগল সে। ঘন তুষারে আচ্ছাদিত হওয়ায় রাস্তা প্রচণ্ড পিচ্ছিল, তাই গাড়ির গতিও বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে শহর ছেড়ে বাইরে যেতে তাদের চল্লিশ মিনিট সময় পেরিয়ে গেছে। অথচ গ্রীষ্মে এই দূরত্বটা পেরুতে পনের মিনিট হলেই যথেষ্ট ছিল।

গাড়ি তুন্দ্রার পথ ধরে এগোতে লাগল। আশেপাশে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে। এ পথে যানবাহনের চলাচল নেই বললেই চলে। তথাপিও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। ধূসর পরিবেশে আলো না জ্বালিয়ে গাড়ি চালালে বিপদের সম্ভাবনাও আছে। শাঁ শাঁ বেগে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটছে গাড়ি। হিসাব অনুযায়ী এই গতিতে চলতে পারলে ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যেই তুন্দ্রার সার্কেলে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে পথে যদি কোথাও অতিরিক্ত তুষার জমে থাকে তাহলে সময়মতো পৌঁছানো কঠিন হবে। কারণ এই রুটে যানবাহনের যাতায়াত এমনিতেই কম, ফলে রাস্তাও সবসময় পরিষ্কার থাকে না।

প্রায় চার ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছে গাড়ি। সুনশান নীরবতা আর তুষারাচ্ছন্ন পাইন বন মাড়িয়ে তুন্দ্রার পথ ধরে গাড়ি ছুটে চলছে। দুপাশে তাকিয়ে আছে দুজন, এখানকার গ্রামের পথ এতটা উন্নত আর পরিচ্ছন্ন হতে পারে তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল এতদিন। সাইবেরিয়ার গ্রামের দিকে এই প্রথম এসেছে পর্যটকেরা। আগে কখনও সাইবেরিয়ার গ্রামীণ পরিবেশ দেখার সুযোগ হয়নি তাদের, ফলে প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল দুজন। দেখতে দেখতে পাঁচ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। শহরের কাছাকাছি থাকতে দু-চারটা গাড়ি নজরে পড়লেও এখন আর রাস্তায় কোনো গাড়ি নজরে পড়েনি; এমনকি জনমানবেরও সাক্ষাত মিলেনি।

গাড়ি পাইন বন ধরে এগোচ্ছে। যতই সামনে এগোচ্ছে, ততই যেন নীরব হয়ে আসছে পাইন বন। হিসাব মতে আর দুই ঘণ্টার মধ্যে তুন্দ্রায় পৌঁছানোর কথা। সময় কমে আসায় পর্যটকদের মনে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। বিশ্বের শীতলতম একটা জায়গা তুন্দ্রা অঞ্চলে ভ্রমণে যাচ্ছে, বিষয়টা কম কথার নয় কিন্তু। এমন সুযোগ জীবনে আর কখনও নাও আসতে পারে। মনের আনন্দে দুজন হাসি তামশা করছে, এমনি সময় হঠাৎ ঝাঁকিমেরে গাড়ি থেমে গেল। আন্দ্রে বলল, ‘ইঞ্জিন ডিস্টার্ব দিয়েছে।’ ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৭) চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত