ঢাকা শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

১০ মহররম ও শাহাদতে কারবালার পটভূমি

১০ মহররম ও শাহাদতে কারবালার পটভূমি

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। আজকের দিনটি ৮ মহররম ১৪৪৭ হিজরি। আগামীকাল রোববার ১০ মহররম। ১০ মহররমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সৃষ্টিজগতের অনেক বিস্ময়কর ঘটনা। একটি ঘটনার কথা বোখারি ও মুসলিম শরীফে আছে। নবী করিম (সা.) হিজরতের পর মদীনায় এসে দেখেন, ১০ মহররম ইহুদিরা রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, ১০ মহররম তারিখে বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় ফেরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। মুসা (আ.) ফেরাউন বাহিনীর উপর বিজয়ী হয়েছিলেন। ফেরাউন ও তার বিশাল বাহিনী মিসরের নীলনদে ডুবে মরে গিয়েছিল। আর মুসা (আ.) নির্যাতিত বনি ইসরাঈলকে নিয়ে নিলনদ পার হয়ে যান। তার শোকরিয়া স্বরূপ মদীনার ইহুদিরা রোজা পালন করছে। নবীজি বললেন, আমরা মুসলমানরাই তো নবী মুসা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অধিক হকদার। তিনি সত্য দ্বীনের অনুসারী ছিলেন, আমরাও সত্য দ্বীনের অনুসারী। অতঃপর, তিনি রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ ফরজ ওয়াজিব অর্থে নয়, বরং সুন্নাত মুস্তাহাব অর্থে। আরেক বর্ণনা মোতাবেক নবীজি মহররমের রোজা রাখলে তাকে বলা হলো, এই দিন তো ইহুদিরাও রোজা রাখে। তিনি বললেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি মহররমের ৯ তারিখ ও ১০ তারিখ দুদিন রোজা রাখব। ইহুদিদের সংস্কৃতি সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতির বৈপরিত্য দেখানোই এর উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্যে নবীজি দুনিয়ার জীবন শেষ করে চলে যান। রোজার ফযিলত সম্পর্কে নবীজি বলেছেন, আমি আশাবাদী, এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা অতীতের ১ বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। এখন যদি কেউ ১০ মহররমের একটি রোজাও রাখেন তিনি নবীজির সেই সুসংবাদের ভাগী হবেন। অতএব, আমরা আজ রাতে সেহরি খেয়ে ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখব। কোনো কারণে ৯ তারিখ রাখতে না পারলে ১০ ও ১১ মহররম তারিখেও রোজা রাখা যাবে। এই রোজা সুন্নাত।

১০ মহররম আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসে একটি হৃদয়বিদারক শোকাবহ ঘটনার স্মারক। এই ঘটনায় নবীজির কলিজার টুকরো নাতি ইমাম হোসাইন (রহ.) তার নানার অনুসারী মুসলমানদের হাতে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে শাহাদত বরণ করেন। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা কীভাবে ঘটল তা জানার জন্য আমাদের যেতে হবে পেছনে। নবীজি (সা.) নবুয়াত লাভ করেন ৪০ বছর বয়সে। ১৩ বছর মক্কায় ইসলাম প্রচারের পর মদীনায় হিজরত করেন ৫৩ বছর বয়সে। হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় হিজরি সন গণনার সূচনা।

হিজরি ১০ম সালে নবীজি দুনিয়ার জীবন শেষ করে বিদায় নেন। তারপর ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। আড়াই বছর পর খলিফা হন হযরত ওমর (রহ.)। তিনি ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে শাহাদত বরণ করলে খলিফা হন হযরত উসমান (রা.)। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন ১২ বছর। ততদিনে রাষ্ট্রে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটতে থাকে। হযরত উসমান শাহাদত বরণ করলে ইসলামী জাহান পরিচালনা করার দায়িত্ব নেন হযরত আলী। তিনিও খারেজি সম্প্রদায়ের গুপ্তঘাতকের হাতে নামাজরত অবস্থায় আক্রমণের শিকার হয়ে শহিদ হন।

উল্লেখ্য যে, হাজারো গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও ইসলামের অকুতোভয় এই চারজন খলিফা ইসলামের পথ, ন্যায়ের পথ থেকে এক এক চুল পরিমাণ বিচ্যুত হননি। তাই ইসলামের ইতিহাস তাদেরকে খোলাফায়ে রাশেদীন নামে স্মরণ করে। রাশেদুন মানে সত্যনিষ্ট। যারা নিজেরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং জনগণকেও সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালনা করেছেন। নবীজি বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত বা নীতি এবং আমার পরবর্তী খলিফাদের নীতি অনুসরণ করবে।’ আপনারা এই হাদীস প্রায় সকল আলেমের মুখে শুনে থাকবেন। নবীজি যে বললেন, তোমরা আমার ও আমার খলিফাদের নীতির অনুসরণ করবে। খলিফাদের নীতি বলতে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির বাইরে তো কিছু হতে পারে না। নবীজি (সা.)-ও মদীনায় হিজরত করার পর ১০ বছর মদীনা কেন্দ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তার মানে মুসলমান কোনো দিন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। আমি রাজনীতির কথা বলছি না। কারণ, রাজনীতি শব্দটি এখন দলবাজি বা দলাদলি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় বেশি।

বিষয়টির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কয়দিন আগেই ইসরাঈল আমেরিকা মিলে ইরানের ওপর হামলা করেছিল, ইরানিরা যদি তাদের না ঠেকাতো তাহলে গোটা মুসলিম জাহানের অবস্থা হত ব্রিটিশের গোলামী যুগের মতো। বলা হত, ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশাল বিস্তৃত দুনিয়া তারা গ্রাস করেছিল। এবার ইরানিরা ওদের না ঠেকালে আমাদের অবস্থাও হত আমাদের বাপ-দাদার আমলে ইংরেজদের দাসত্বের মতো। তারা প্রথমে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানকে ধরত। তারপর ধরত তুরস্ককে। আরবের নির্লজ্জ শেখরা তো আগেই থেকেই নিজেদের অন্দরমহল ওদের হাতে তুলে দিয়েছেন। অতএব, প্রতিটি মুসলমানকে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। উদাসীন থাকার সুযোগ নেই।

হিজরি ৪০ বছরে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের সমাপ্তি ঘটে। এরপর আসে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। হযরত আলীর শাহাদতের পর মুসলমানরা তার প্রথম পুত্র হযরত ইমাম হাসানকে খলিফা হিসেবে মনোনীত ও তার হাতে বায়আত গ্রহণ করে। কিন্তু তার শাসনকাল ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। হযরত আলীর বিরোধ ছিল সিরিয়ার গভর্নর আমীর মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে। আমীর মুয়াবিয়ার বিশাল ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির মোকাবিলায় ইমাম হাসান দেখলেন যে, শুধু মুসলমানদের রক্তক্ষয় হবে, তিনি জিততে পারবেন না। অতপর. আমীর মুয়াবিয়া (রা.)-এর অনুকূলে তিনি খেলাফতের দাবি ত্যাগ করেন।

৬০ হিজরি পর্যন্ত মুসলিম জাহানের খলিফার আসনে সমাসীন হন হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা.)। তিনি ছিলেন আরবের বিখ্যাত উমাইয়া বংশের লোক। তিনি অতীতের যুদ্ধবিগ্রহ হানাহানি রক্তপাতের অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তা করলেন, উমাইয়া বংশের কোনো লোক না হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। কারণ, এরইমধ্যে উমাইয়া বংশের লোকেরা সরকারী পদ পদবি দখল করে ফেলেছে। তাই তিনি মুগিরা ইবনে শোবার পরামর্শে পুত্র এজিদকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে ছেলেকে উপদেশ দেন যে, তুমি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর চারজন ব্যক্তিকে দেখবে যে, তোমার বিরোধীতার অনড়। এর মধ্যে দুজন খুবই ভয়ঙ্কর। একজন হোসাইন ইবনে আলী আরেকজন আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর। তুমি তাদের সাথে ঝামেলা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু ৬০ হিজরিতে আমীর মুয়াবিয় (রা) এর ইন্তিকালের সাথে সাথে এজিদ মদীনায় নিযুক্ত গভর্নরকে নির্দেশ দেয়, যেভাবেই হোক উল্লেখিত দুইজনের কাছ থেকে বাইয়াত বা রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হবে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তারা আঁচ করতে পারলেন যে, তাদের হয় এজিদের হাতে বায়আত গ্রহণ করতে হবে, নতুবা তাদের হত্যা করা হবে। কিন্তু হোসাইন ইবনে আলী রাসূলের নাতি হয়ে তো কোনো ফাসেক ফাজেরের হাতে বায়আত করতে পারেন না। তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের সামনে দৃষ্টান্তে পরিণত হবে যে, শাসক ইসলামের বিরুদ্ধাচরণকারী হলেও তার প্রতি আনুগত্য করতে হবে বা যেকোনো শাসককে মেনে নিলে ঈমান ও আমলে কোনো অসুবিধা হবে না। এজিদ ছিল লম্পট ও মদ্যপ। ইতিহাস তাকে এজিদে পলীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পলীদ মানে নাপাক। যাইহোক, রাতের অন্ধকারে তারা দুজনই পৃথকভাবে পরিবার পরিজনসহ মদীনা ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন। কারণ মক্কা ছিল নিরাপদ এবং খানায়ে কাবা ছিল নিরাপত্তার গ্যারান্টি। এ ছিল রজব মাসের ঘটনা।

মক্কায় থাকাকালীন কুফার গণ্যমান্য লোকেরা ইমাম হোসাইনের কাছে একের পর এক চিঠি লিখতে থাকে। চিঠির অভিন্ন বক্তব্য ছিল দামেস্কের মসনদে এজিদ ক্ষমতাসীন হয়েছে আমরা দুশ্চরিত্র এজিদের আনুগত্য করতে করব না। আপনি আসেন, আপনিই আমাদের শাসক হবেন, আপনার নেতৃত্বে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত। প্রায় এক বস্তা চিঠি জমা হওয়ার পর ইমাম হোসাইন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কুফায় চলে যাবেন। কারণ, মক্কায় থাকলে তাকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ চালানো হবে, তাতে আল্লাহর ঘরের সম্মানহানি হবে, হেরেমে রক্তপাত ঘটবে। মক্কার গণ্যমান্য সবাই অনুরোধ করল, আপনি রাসূলের নাতি, আমাদের নয়নের মণি, আপনি আমাদের মাঝেই থাকেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, আমার সিদ্ধান্ত, আমি কুফার লোকদের মাঝে চলে যাব। তবে দেখব আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে খেলাফতের মর্যাদা রক্ষার খাতিরে কে কে আমার সাথে যেতে আগ্রহী।

দীর্ঘ কয়েক মাস মক্কায় অবস্থানের পর তিনি কুফা যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করলেন। আমরা হজের সময় ৮ জিলহজ মীনায় যাই, ৯ তারিখ আরাফায় মূল হজ আর ১০ তারিখ কোরবানি। ইমাম হোসাইন কুফায় রওনা হলেন ৮ জিলহজ। কারণ, তিনি এর আগে একাধিকবার হজ করেছেন। এ হজ তার জন্য নফল। দ্বিতীয়ত হয়ত চিন্তা করেছেন হজের সময় গুপ্তঘাতক দিয়ে তাকে হত্যা করা হবে। রওনা হওয়ার আগে কুফাবাসীর পত্রের উপর তিনি নির্ভর করলেন না; বরং চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠালেন সরেজমিনে গিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় পৌঁছলে ১৮ হাজার মানুষ তার মাধ্যমে ইমাম হোসাইনের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। তিনি তা পত্রযোগে ইমাম হোসাইনকে জানিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার অনুরোধ জানান। ইমাম রওনা হলেন, পথিমধ্যে জানতে পারলেন কুফাবাসী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কুফার নতুন গভর্নরের চক্রান্তে তারা উল্টা মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যা করেছে।

(ঢাকা বায়তুশ শরফ মসজিদে জুমার খুতবাপূর্ব আলোচনার একাংশ)

মহররম,কারবালা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত