প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫
নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র : ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে আলোচিত হয়; যখন জোহরান কাওয়ামি মামদানি বিপুল জনসমর্থনে বিজয়ী হন। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নগরীতে এই প্রথম কোনো মুসলিম রাজনীতিক শহরের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নির্বাচিত হন। এমন এক সময়ে এ ঘটনা ঘটে, যখন পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় পরিচয়, অভিবাসন ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছিল। নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত মামদানি তার প্রচারণায় আবাসন সংকট, লাগামছাড়া ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, সামাজিক বৈষম্য এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রার চাপকে প্রধান ইস্যু করেন। বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর নিউইয়র্কে এসব প্রতিশ্রুতি তরুণ ভোটার, অভিবাসী জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তার এ বিজয়ের পেছনে সময় ও বাস্তবতার বড় ভূমিকা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে বহুজাতিক ও বহু ধর্মীয় শহর হলেও নিউইয়র্কের রাজনৈতিক নেতৃত্বে সেই বৈচিত্র্যের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়নি। মামদানির জয় সেই ঘাটতি আংশিকভাবে পূরণ করে। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তার মুসলিম পরিচয়কে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাও দেখা যায়; যা সামাজিক বিভাজনের আশঙ্কা তৈরি করে। যদিও বড় ধরনের সহিংসতা হয়নি; তবু এসব বিতর্ক শহরের রাজনৈতিক পরিবেশে চাপ সৃষ্টি করে। এ নির্বাচনের প্রভাব নিউইয়র্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি মুসলিম ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতার ধারণায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সব মিলিয়ে জোহরান কাওয়ামি মামদানির বিজয় ২০২৫ সালের বৈশ্বিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে একটি প্রতীকী বাঁক হিসেবে বিবেচিত হয়। যা দেখায়- সমাজ ও জনমতের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রও নতুন বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের সন্ত্রাসী হামলা : ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি গভীর রাতে ইসরায়েল ইরানের ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। ইরানি সরকারি টেলিভিশন ও নিরাপত্তা সূত্রে জানানো হয়, তেহরান ও আশপাশের এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে এবং ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা (ওজওই)-এর প্রযুক্তিগত স্থাপনা, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, পাশাপাশি ইরানি সেনাবাহিনী ও রেভল্যুশনারি গার্ডের কিছু অবস্থানস্থল লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হয়। এ হামলা এমন এক সময়ে হয়, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছিল। ইসরায়েলি পক্ষ দাবি করে, ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও আঞ্চলিক কার্যক্রম দুর্বল করতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সরকারি গণমাধ্যম ও সেনাবাহিনীর স্থাপনায় হামলা স্পষ্টতই আগ্রাসনমূলক এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইরানি কর্তৃপক্ষ জানায়, হামলায় সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি আশপাশের বেসামরিক অবকাঠামোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকজন সেনাসদস্য নিহত ও আহত হন। এ হামলার প্রতীকী দিকটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও সামরিক অবস্থান লক্ষ্যবস্তু হওয়া মানে শুধু স্থাপনার ক্ষতি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর সরাসরি আঘাত। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং পুরো অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা সতর্কতা জোরদার করা হয়। তেহরান, ইসফাহান ও আশপাশের সামরিক এলাকায় বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়। এ হামলার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়। মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা যায়। বহু দেশ এটিকে ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির আরেকটি উদাহরণ হিসেবে আখ্যা দেয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বৈত নীতির অভিযোগ আরও জোরালো হয়। ক্ষমতার ভারসাম্যের দিক থেকে এ হামলা ইসরায়েলের সাময়িক শক্তি প্রদর্শন হলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা ইরানের প্রতিরোধী অবস্থান ও আঞ্চলিক মিত্রদের আরও ঐক্যবদ্ধ করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্প : ২০২৫ সালের ১৮ আগস্ট ভোর রাতে স্থানীয় সময় ৩টা ২০ মিনিটে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় নাঙ্গারহার ও কুনার প্রদেশসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল প্রায় ৬.১। যার উৎপত্তি স্থল ছিল হিন্দুকুশ পর্বতমালার সক্রিয় ফল্ট অঞ্চল। গভীর রাতে কম্পন অনুভূত হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বহু গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ দুর্যোগ ঘটে এমন সময়, যখন আফগানিস্তান দীর্ঘ যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আগেই মানবিক বিপর্যয়ে ছিল। সরকারি হিসেবে দু’হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়; যদিও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় উদ্ধারকাজ বিলম্বিত হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করে। কাঁচা মাটি ও পাথরের ঘর ধ্বসে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা। বহু মানুষ ঘরহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; আগস্টের কৃষি মৌসুমে ফসলি জমি নষ্ট হয়, পানির কূপ ও সেচব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় এবং সড়ক-সেতু ভেঙে পড়ায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। পর্যাপ্ত হাসপাতাল, ওষুধ ও চিকিৎসকের অভাবে অনেক আহত ব্যক্তি সময়মতো চিকিৎসা পাননি। ফলে স্থানীয় মানুষ নিজেরাই খালি হাতে উদ্ধারকাজে নামতে বাধ্য হয়। এ ভূমিকম্প আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তালেবান সরকার তাৎক্ষণিক সহায়তার চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত অর্থ ও অবকাঠামোর অভাবে সবার কাছে সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগস্টের শেষ দিকে ত্রাণ পাঠালেও রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে তা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত
ছিল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ভূমিকম্প আফগানিস্তানের মানবিক সংকট ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে আলোচনা উস্কে দেয়। ঘটনাটি দেখিয়ে দেয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় শুধু প্রাকৃতিক শক্তিই নয়; রাষ্ট্রের সক্ষমতা, সদিচ্ছা ও সামাজিক ঐক্যই সবচেয়ে বড় নির্ধারক হয়ে ওঠে।
নেপালে ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতন : ২০২৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সূচনা হয়, যখন দেশটির সরকার হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্সের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজধানী কাঠমা-ুসহ সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। সরকার এ সিদ্ধান্তকে প্রশাসনিক ও আইনগত কারণ দেখিয়ে ব্যাখ্যা করলেও সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখে। এ ক্ষোভ থেকেই দ্রুত সংগঠিত হয়ে রাস্তায় নামে মূলত জেনারেশন জেড নামে পরিচিত তরুণ প্রজন্ম। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কর্মজীবী তরুণ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় নাগরিকরাই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান শক্তি। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ হলেও খুব অল্প সময়েই দাবির পরিসর বিস্তৃত হয়। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দীর্ঘদিন ধরে একই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আধিপত্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবনতির মতো বিষয়গুলো আন্দোলনের মূল শ্লোগানে পরিণত হয়। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানী কাঠমা-ু, পোখারা ও অন্যান্য বড় শহরে লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের কঠোর দমন-পীড়নের ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই ৭০-এর বেশি মানুষ নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়। সরকারি ভবন, সংসদ ভবনের আশপাশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে; যা পুরো দেশকে কার্যত অচল করে দেয়। এ গণআন্দোলনের চাপ সামলাতে না পেরে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আন্দোলন একটি বড় রাজনৈতিক সাফল্যে রূপ নেয়। কয়েকদিনের আলোচনার পর ১২ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সুশীলা কার্কি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নতুন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করে। এ আন্দোলনের ফলাফল শুধু সরকার পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি প্রমাণ করে, নেপালের তরুণ সমাজ শুধু প্রতিবাদকারী নয়, বরং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সক্রিয় শক্তি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২৫ সালে নেপালের গণআন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়, যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনগণের মৌলিক অধিকার উপেক্ষা করে, তখন সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়।
ভারতে নতুন বাবরি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা : গত নভেম্বর মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে নতুন বাবরি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেশীয় পরিসর ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে আলোচনার জন্ম দেয়। এ ঘোষণা শুধু একটি স্থাপনা নির্মাণের বিষয় নয়; বরং ভারতীয় মুসলমানদের দীর্ঘদিনের বেদনা, স্মৃতি ও আত্মসম্মানের প্রতিফলন হিসেবেই সামনে আসে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা আজও মুসলিম সমাজের কাছে এক গভীর ক্ষত ও কান্নার স্মৃতি। বহু মুসলমানের দৃষ্টিতে সেটি শুধু একটি উপাসনালয় ধ্বংস নয়, বরং সংগঠিত সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যার নিরপেক্ষ বিচার আজও পূর্ণতা পায়নি। এ বাস্তবতায় নতুন বাবরি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা অনেক মুসলমানের কাছে ঐতিহাসিক ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে, ভারতীয় মুসলমানদের একটি অংশ মনে করে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাবাধীন বর্তমান শাসনব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ ঘোষণা একটি সাহসী অবস্থান। একই সঙ্গে এটি ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নও সামনে আনে; যেখানে সংবিধান উপাসনালয় নির্মাণের অধিকার দিলেও বাস্তবে তা রাজনৈতিক বিতর্ক ও চাপের মুখে পড়ে। ঘোষণাকারী কংগ্রেসের বিধায়ক হুমায়ুন কবির জানান, প্রস্তাবিত নতুন বাবরি মসজিদটি অযোধ্যার মূল স্থাপনার বিকল্প নয়; বরং এটি স্মৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, নির্মাণকাজের সম্ভাব্য বাজেট প্রায় ৩০০ কোটি রুপি। এরইমধ্যে দেশ-বিদেশ থেকে বড় অঙ্কের অনুদান আসতে শুরু করেছে। তিনি জানান, ভারতের একজন ব্যবসায়ী একাই ৮০ কোটি রুপি অনুদান দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পড়ে। এতে বোঝা যায়, বাবরি মসজিদ শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের বহু মুসলমানের আবেগের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
বছরজুড়ে গাজা-ইসরায়েল অসম যুদ্ধ : ২০২৫ সালজুড়ে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মানবিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল; যদিও যুদ্ধের শুরু বা আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এ বছরে হয়নি। ২০২৩ সালের শেষভাগে শুরু হওয়া এ সংঘাত ২০২৪ পেরিয়ে ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকে; যেখানে অস্ত্রবিরতি, তা ভঙ্গ এবং পুনরায় হামলার ঘটনা বারবার বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গাজায় একটি সীমিত মেয়াদের অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়। এতে ইসরায়েলি হামলা সাময়িক বন্ধ রাখা, মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং বন্দি বিনিময়ের শর্ত ছিল। এ বিরতির মূল লক্ষ্য ছিল গাজা সিটি ও খান ইউনিসে ত্রাণ পৌঁছানো। এরপর মার্চে জাতিসংঘের চাপের মুখে ৭২ ঘণ্টার আরেকটি মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও, উত্তর গাজায় ইসরায়েলি নিরাপত্তা অভিযানের অভিযোগে সেটিও কার্যত ভেঙে পড়ে। সবচেয়ে বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি হয় জুন ২০২৫-এ; যখন কায়রোতে শর্তসাপেক্ষ অস্ত্রবিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও রাফাহ সীমান্ত এলাকায় পুনরায় বিমান হামলা শুরু হয়। এতে নতুন করে প্রাণহানি ঘটে এবং অস্ত্রবিরতির ওপর আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০২৫ সালে এসব যুদ্ধবিরতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের অস্থায়িত্ব; মানবিক শর্ত থাকলেও বাস্তবে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। হাসপাতাল, স্কুল ও শরণার্থী শিবিরে হামলার অভিযোগও চলতে থাকে।
আধিপত্যবাদের নখরথাবায় ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে শহিদ শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী একটি গভীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চলতি মাসের ১২ তারিখ জুমার পর ঢাকার নয়াপল্টন বক্স কালভার্ট রোডে রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজ সংগঠক শরফি ওসমান হাদি মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। রিকশায় চলার সময় পরিকল্পিতভাবে চালানো এ হামলায় তার মাথা এফোড়-ওফোড় হয়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলেও ১৮ ডিসেম্বর তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। ওসমান হাদি ছিলেন তরুণ সমাজের কাছে পরিচিত এক স্পষ্টভাষী কণ্ঠ। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক আধিপত্য, বিদেশি শক্তি ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে জলন্ত অগ্নি ছিলেন। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে সর্বদা শক্ত অবস্থান নিতেন। এ কারণেই তার হত্যাকে অনেকেই একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর দাপট ও ভিন্নমতের প্রতি সহিংস দমননীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন। পুলিশি তদন্তে ফয়সাল করিম মাসুদকে এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তদন্তে আরও উঠে আসে, হত্যার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সহযোগীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়; যা বিচারপ্রক্রিয়া ও আইনের শাসন নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে। এ ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দ্রুত গ্রেপ্তার ও স্বচ্ছ বিচারের দাবি জানায়। ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক পরিসরেও আলোচিত হয়। কারণ, এটি শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়; বরং আধিপত্যবাদী রাজনীতির মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলা একজন মানুষের পরিণতির প্রতীক। এ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়; এটি মতপ্রকাশের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। সবশেষে বলা যায়, ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা; যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে, ক্ষমতার দাপটই শেষ পর্যন্ত সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
ইরানের ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের ওপর মার্কিন হামলা : ২০২৫ সালের ২২ জুন গভীর রাতে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আবারও যুদ্ধের ছায়া ঘনিয়ে আসে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি সামরিক হামলা চালায়। যা ছিল অনেকের মতে সরাসরি সন্ত্রাসী হামলার নামান্তর। ইরানের ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে এ আক্রমণ পরিচালিত হয়। ইরানি কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, আধুনিক যুদ্ধবিমান ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে চালানো এ হামলা ছিল বহু বছর ধরে চলমান ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকাশ। এ হামলার পেছনে মূল কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, ইরান দ্রুত অস্ত্রমানের ইউরেনিয়াম উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছে। তা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ ছিল, যা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে উদ্বিগ্ন। তবে ইরান বরাবরই বলে এসেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ও জ্বালানি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। সেই অবস্থায় সরাসরি হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসন হিসেবেই দেখা হয়। হামলায় ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কিছু প্রযুক্তিগত স্থাপনা সাময়িকভাবে অচল হয়ে পড়ে। যদিও ইরান দাবি করে, গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম মজুদের বড় অংশ আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু এ আক্রমণ দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচিতে বড় ধাক্কা দেয়। আশপাশের এলাকায় বিস্ফোরণে বেসামরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক