ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পুলিশ ও জনআস্থার সংকট

আরিফুল ইসলাম রাফি
পুলিশ ও জনআস্থার সংকট

নাগরিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো পুলিশ। আইন প্রয়োগ, জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অপরাধ দমন এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্ব তাদের কাঁধে। কিন্তু এই দায়িত্ব যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ততটাই সংবেদনশীল। এই সম্পর্কের ভিত্তি হলো জনআস্থা, যে আস্থা পুলিশের ন্যায় বিচারমূলক আচরণ, পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও মানবিকতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বহু দেশে; বিশেষত আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এই জনআস্থার ভিত ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে সন্দেহ, ভয় ও অনাস্থার এক গভীর সংকট।

পুলিশ ও জনআস্থার সংকট হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের জমে থাকা অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা ও কাঠামোগত সমস্যার ফল। সাধারণ নাগরিকের চোখে পুলিশ আজ আর শুধু নিরাপত্তার প্রতীক নয়; অনেক সময় তা হয়ে উঠছে ক্ষমতার অপব্যবহার, হয়রানি কিংবা ভয়ের নাম। থানায় গিয়ে ন্যায্য বিচার পাওয়া যাবে, এই বিশ্বাস বহু মানুষের মনে আর আগের মতো দৃঢ় নেই। অভিযোগ গ্রহণে গড়িমসি, মামলা নিতে অনীহা, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের বিনিময়ে সুবিধা দেওয়া বা নেওয়ার অভিযোগ; এসব বিষয় ধীরে ধীরে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষয় করেছে।

এই সংকটের একটি বড় কারণ হলো ক্ষমতার অপব্যবহার ও জবাবদিহির অভাব। পুলিশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বৈধ শক্তি প্রয়োগের অধিকার পায়। কিন্তু যখন সেই শক্তি আইন ও নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে, তখন তা রক্ষাকারী থেকে নিপীড়কে পরিণত হয়। বেআইনি গ্রেপ্তার, হেফাজতে নির্যাতন, তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’, ভিন্নমত দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ; এসব ঘটনা জনমনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব ঘটনার পর যথাযথ তদন্ত ও শাস্তি না হলে মানুষের মনে ধারণা জন্মায় যে পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে। রাজনৈতিক প্রভাবও পুলিশের প্রতি জনআস্থার সংকটকে তীব্র করেছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না দেখে ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। বিরোধী মত দমন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পক্ষপাতমূলক আচরণ, নির্বাচনকালীন ভূমিকা; এসব প্রশ্নে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যখন জনগণ মনে করে পুলিশ দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে, তখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়।

একই সঙ্গে সামাজিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যও এই সংকটে বড় ভূমিকা রাখে। প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ অনেক সময় নমনীয়, অথচ দরিদ্র, শ্রমজীবী বা প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রে তা হয় কঠোর ও অবমাননাকর, এমন অভিযোগ নতুন নয়। থানায় গেলে সাধারণ মানুষকে অবহেলার চোখে দেখা, ঘুষ ছাড়া কাজ না হওয়া, ভুক্তভোগীর বদলে প্রভাবশালী অপরাধীর পক্ষ নেওয়ার ঘটনা জনআস্থাকে গভীরভাবে আঘাত করে। ফলে পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গায় জন্ম নেয় ক্ষোভ ও হতাশা।

পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকেও উপেক্ষা করা যায় না। অতিরিক্ত কর্মচাপ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা, নিম্নপদস্থ সদস্যদের ওপর ঊর্ধ্বতনদের চাপ; এসব বিষয় পুলিশের আচরণ ও পেশাদারিত্বকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় একজন ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পুলিশ সদস্য নাগরিকের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংযম ও সহানুভূতি দেখাতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এসব বাস্তবতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে দায়ভার গিয়ে পড়ে পুরো বাহিনীর ওপর।

এই আস্থাহীনতার ফল শুধু পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব পড়ে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়। মানুষ যখন পুলিশকে বিশ্বাস করে না, তখন তারা আইন মানতে আগ্রহ হারায়, অপরাধের তথ্য দিতে ভয় পায়, বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা কমে যায়। অপরাধ দমন কঠিন হয়ে পড়ে, সমাজে নৈরাজ্য বাড়ে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র নিজেই।

তবে এই সংকট অচল নয়। পুলিশ ও জনআস্থার সম্পর্ক পুনর্গঠন সম্ভব, যদি আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথমত, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেখানে অপরাধ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পেশাদার পুলিশিং প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে পুলিশ শুধু আইন ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। তৃতীয়ত, মানবাধিকারভিত্তিক প্রশিক্ষণ, আচরণগত উন্নয়ন এবং জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো উদ্যোগকে শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, বাস্তব অর্থে কার্যকর করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুলিশের মানসিকতার পরিবর্তন। জনগণকে নিয়ন্ত্রণের বস্তু নয়, সেবা গ্রহণকারী নাগরিক হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। অন্যদিকে নাগরিকদেরও পুলিশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। পারস্পরিক এই বোঝাপড়া ও আস্থার ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে একটি নিরাপদ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। পুলিশ ও জনআস্থার সংকট আসলে একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্য সূচকের প্রতিফলন। যেখানে পুলিশ জনগণের বন্ধু, সেখানে আইন শক্তিশালী হয়; আর যেখানে পুলিশ ভয়ের প্রতীক, সেখানে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এই সংকটকে অস্বীকার নয় বরং স্বীকার করে সমাধানের পথে এগোনোই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত