রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ যে বিগত সাড়ে ১৫ শত বছর পরও মানবসমাজে অদ্যাবধি জীবন্ত রয়েছে, তার পেছনে অন্যতম বড় অবদান হাদিসের। যদি হাদিস সংরক্ষিত না থাকত, রাসুল (সা.)-এর চলার পথ আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল না থাকত, তাহলে শত শত বছর ধরে ইসলামি সভ্যতার যে মহান চিত্তাকর্ষক ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে, তা কখনই অস্তিত্ববান হতে পারত না। যদি হাদিস না থাকত তবে মুসলিম সমাজ একটি আদর্শ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনব্যবস্থার অধীনস্ত হতে পারত না। যদি হাদিস না থাকত তাহলে প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক শহরে এত এত বিদ্বান ও সংস্কারকের জন্ম হতো না। সমাজকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করার জন্য সংস্কারধর্মী মানদ-ের অস্তিত্ব থাকত না। হক-বাতিল, ভালো-মন্দকে পৃথক করার কোনো স্থায়ী নীতিমালা থাকত না। হাদিসের কারণে মুসলিম উম্মাহ পুরোপুরি আদর্শের ভিত্তিতে মানবসমাজ গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করেছে। এ পৃথিবীকে তারা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে উত্তম চরিত্র এবং মানবতাবোধের অসংখ্য হিরণ¥য় নজির। কোরআন যদি হয় তাত্ত্বিক প্রেরণা, হাদিস হলো তার ব্যবহারিক প্রেরণা। এই দ্বিবিধ প্রেরণার সমন্বয়েই সম্ভব হয়েছে এক নতুন সভ্যতার বিনির্মাণ, যার তুলনীয় উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও ছিল না এবং আগামীতেও হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)।
আবুল হাসান আলি নদভি (রহ.) বলেন, ‘হাদিসের গ্রন্থসমূহ মুসলিম উম্মাহর সংস্কার, রেনেসাঁ এবং সেইসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধতার অন্যতম উৎস হয়ে রয়েছে। যুগে যুগে সংস্কারকরা এই উৎস থেকে দ্বীনের শুদ্ধ ও স্বচ্ছ জ্ঞান আহরণ করেছেন। তারা এ সকল হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একে দ্বীনের পথে ও সংস্কারের ময়দানে মানুষকে আহ্বানের সূত্র হিসেবে ধারণ করেছেন এবং তারা যাবতীয় অনাচার-দুরাচার ও নবসৃষ্ট বিষয়াদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন এর মাধ্যমে। প্রত্যেক যুগে যারা মুসলিম সমাজকে পরিপূর্ণ ইসলামের দিকে এবং সঠিক দ্বীনের দিকে আহ্বান করতে চায়, যারা নিজেদের মধ্যে এবং রাসুল (সা.)-এর পরিপূর্ণ আদর্শ জীবনের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলতে চায় এবং যারা যুগের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজন অনুভব করে, তাদের জন্য হাদিসের বিকল্প কিছু নেই।’ (আবদুর রহমান আল-ফিরইয়াই, জুহুদ মুখলিসাহ ফি খিদমাতিস সুন্নাহ আল-মুতাহ্হারাহ, পৃষ্ঠা : ৩৫-৩৭)।
হাদিসে যে ইসলামি সভ্যতার প্রাণ তার বড় প্রমাণ হলো, যখনই মুসলমানদের সঙ্গে হাদিসের যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে বা দুর্বল হয়েছে, তখনই মুসলিম উম্মাহ হয় চিন্তা ও দর্শনের দিক থেকে, না হয় রাজনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেছে, হোক না সে সময় দায়িদের সংখ্যা অনেক বেশি কিংবা যুক্তিবাদ ও সুফিবাদ চর্চাকারীদের জয়জয়কার। হাদিসের সঙ্গে যখনই তাদের সম্পর্কোচ্ছেদ ঘটেছে, তখনই তাদের মধ্যে সংস্কারের আওয়াজ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং জ্ঞানের বাতিও নিভতে শুরু করেছে। এ এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
উদাহরণস্বরূপ ভারত উপমহাদেশের কথা বলা যায়। দশম হিজরি শতক থেকে উপমহাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে হাদিসের উপস্থিতি প্রায় বিরল হয়ে ওঠে। হাদিসের পঠন-পাঠন বন্ধ হয়ে সেখানে স্থান করে নেয় বিভিন্ন মাজহাবের ফিকহগ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যাগুলো। স্থান করে নেয় উসুল এবং যুক্তিবিদ্যার গ্রন্থসমূহ। যার ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, এই উপমহাদেশে বেদয়াতের ছড়াছড়ি সৃষ্টি হয়। ধর্মের নামে হাজারো রসমণ্ডরেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। মানুষেরা ইবাদতের জন্য নানা পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
নানা ধর্মীয় উৎসবের আবির্ভাব ঘটায়। নেককার লোকদের কবর ঘিরে মুসলমানদের আনাগোনা বাড়ে। সেখানে খানকাহ বানিয়ে তাদের কবরে সেজদা দেওয়া শুরু করে। কবরে বাতি জ্বালিয়ে অনুগ্রহ অর্জনের প্রতিযোগিতায় মানুষ লিপ্ত হয়। এভাবে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপ প্রায় বিতাড়িত হয়ে যায় উপমহাদেশ থেকে। অবশেষে মুজাদ্দিদ আলফে সানি খ্যাত আহমাদ ইবনু আব্দুল আহাদ আস-সারহিন্দি রুখে দাঁড়ালেন এসবের বিরুদ্ধে। তিনি মানুষকে আহ্বান করলেন সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার দিকে। ময়দানে নামলেন বেদয়াতের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দাওয়াত নিয়ে। (আবুল হাসান আলি নদভি, মুহাজারাতুন ইসলামিয়াতুন ফিল ফিকরে ওয়াদ দাওয়াহ, তাহকিক : আব্দুল মাজেদ আল-গাওরি, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৫৭৫)।
গ্রহণযোগ্য বেদয়াত নামে যে ধারণা প্রচলিত ছিল তা তিনি পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য ঘোষণা করলেন। সুফিদের মধ্যে প্রচলিত ‘আল্লাহ সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান’ এই আকিদার বিরুদ্ধে তিনি গ্রহণ করেন কঠোর অবস্থান। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা আরবের মুহাম্মাদ (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীর মুখাপেক্ষী, কোনো শায়খ মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি বা সাদরুদ্দিন কুনুভি বা শায়খ আবদুর রাজজাক আল-কাশির মুখাপেক্ষী নই। আমরা মুখাপেক্ষী কোরআন-হাদিসের। (তাদেব, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৫৭৬)।
একই পদাংক অনুসরণ করে আগমন করলেন আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি এবং হাদিসের প্রচার-প্রসার ও পাঠদানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। তারপর এলেন শায়খুল ইসলাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দিহলভি এবং তার সন্তানগণ ও শিষ্যরা। তারাও একইভাবে হাদিসে প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করলেন। কিতাব ও সুন্নাহর এই মিশনে তারা এমনভাবে সফল হলেন যে, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র থেকে শতসহস্র মাইল দূরে ভারতের বুকে জ্বলে উঠল সুন্নাহর এক মহান প্রদীপ, গড়ে উঠল হাদিসের এক প্রতাপশালী সাম্রাজ্য। আর একে কেন্দ্র করে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো তাই ভারত উপমহাদেশে ইসলামের নতুন জীবন দান করল। ধারাবাহিকভাবে সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভি, শাহ ইসমাইল শহিদের মতো মহান সংস্কারকদের জন্ম হলো, যাদের কর্মতৎপরতায় মানুষ আবার সঠিক দ্বীনের সন্ধান পেল এবং শত শত বছরের বেদয়াতি প্রথা পরিত্যাগ করতে লাগল। এটা যে ছিল হাদিস ও সুন্নাহর পুনরুজ্জীবনের বাস্তব ফলাফল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু ভারতের বুকেই নয়; বরং সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান সব জায়গাতেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আবুল হাসান আলি নদভি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমি সুনিশ্চিত যে, যদি সুন্নাহর কিতাব ও হাদিসের পাণ্ডুলিপিসমূহের অস্তিত্ব না থাকত; যদি সুন্নাহগুলো জানার কোনো ব্যবস্থা না থাকত; যদি সুন্নাহ এবং বেদয়াতগুলো পৃথক করার সুযোগ না থাকত, তাহৎলে সে সকল মহান সংস্কারক এবং বিজ্ঞ ইমামগণের আবির্ভাব কখনই ঘটত না, যাদের নিয়ে ইসলামের ইতিহাস গৌরবমণ্ডিত হয়েছে।’ (তাদেব, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৫৭৭)। সুতরাং নিঃসন্দেহে হাদিস ইসলামি সভ্যতার বিকাশে অতি আবশ্যকীয় উপাদান।