ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম বিজ্ঞানী-১

চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক ইবনে সিনা

রায়হান রাশেদ
চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক ইবনে সিনা

সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের সূচনা শুরু হয়। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে মানুষ খাদ্যসংগ্রহ ও রোগব্যাধি মোকাবিলায় যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তা থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূত্রপাত। আর তখনকার চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল তাদেরই আবিষ্কৃত ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি। এরপর মানুষের হাত ধরে আসে লতাণ্ডপাতা, গাছ-গাছড়ার ব্যবহার। আধুনিক যুগে মুসলিম মনীষীদের হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। মুসলমানরাই চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক। এ পর্বে আলোচনা করা হবে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক ইবনে সিনাকে নিয়ে।

নবম শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীগণই সভ্যতার প্রকৃত পতাকাবাহক ছিলেন। নবম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। এ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন আবু আলি আল হুসাইন ইবনে সিনা। ইসলামের অন্যতম এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী পুরো বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলে সুপরিচিত। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতিবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। তাকে একইসঙ্গে ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান এবং রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা তাদের জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে দাবি করে। সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর জনক ইবনে সিনা।

জন্ম ও পড়াশোনার হাতেখড়ি : বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী বুখারায় ৯৮০ জন্মগ্রহণ করেন। ইউরোপে আভিসিনা নামে পরিচিত। এই মহান ব্যক্তিকে ‘আশশাইখ আলরাইস’ বা জ্ঞানীকুলের শিরোমণি বলা হয়। তিনি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রভাত পুরুষ।

ইবনে সিনার শিক্ষার হাতেখড়ি বুখারা শহরে। ১০ বছর বয়সে কোরআন মুখস্থ করেন। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন প্রখর মেধাবী। তার মা-বাবা ও গৃহশিক্ষক তার মেধা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। ভারতীয় গণিতশাস্ত্রবিদ এক মেওয়া বিক্রেতার কাছে গণিত শেখেন। জ্ঞানী আল নাতেলির কাছে ফিকহ, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি ও জ্যোতিষশাস্ত্র শেখেন।

বিনিময়ে চাইলেন কুতুবখানায় পড়ার অনুমতি : তৎকালীন বাদশাহ নুহ বিন মনসুর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এদিকে ইবনে সিনার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাদশার কাছে তার ডাক পড়ে। তিনি বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তুললেন। বাদশাহ বেজায় খুশি হলেন। তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি শুধু বাদশাহের কাছে শাহি কুতুবখানায় পড়াশোনার অনুমতি চাইলেন। বাদশাহ অনুমতি দিলেন। তিনি ডুবে গেলেন জ্ঞানের স্বর্গরাজ্যে।

ভ্রমণবিলাসী ছিলেন : ইবনে সিনা ভ্রমণবিলাসী ছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। অন্যতম সমৃদ্ধি নগরী খোয়ারিজমে গিয়ে আলবিরুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাজধানীর গরুগঞ্জে অনেক দিন বসবাস করেন। এখানে বসে আলকানুন ফিততিব লেখেন। এরপর খোরাসানে ভ্রমণ করেন।

ভাণ্ডারে তার বিবিধি রতন : ইবনে সিনা ছিলেন গ্রিক অ্যারিস্টটলীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত একজন পেরিপেটিক দার্শনিক। ধারণা করা হয়, তিনি ৪৫০টি বই লিখেছেন। যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্রবিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক। তার সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলো হলো, কিতাবুশ শিফা একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ এবং কানুন ফিততিব- একটি চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ- যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রামাণিক মেডিকেল পাঠ্যবই হয়ে ওঠে। (উইকিপিডিয়া)

চিকিৎসাশাস্ত্রের উৎসগ্রন্থ আলকানুন ফিততিব : চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ আলকানুন ফিততিব আরব জগৎ থেকে আনিত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। ইবনে সিনার কানুন সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্টি বলেন, ‘কানুনের আরবি সংস্করণ ১৫৯৩ সালে রোমে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটি একটি প্রারম্ভিক যুগের মুদ্রিত গ্রন্থ। আরবি চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার স্থান অদ্বিতীয়।’

চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। হৃদরোগের কারণ হিসেবে তিনিই প্রথম মানুষের মানসিক অবস্থাকে (রোগ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি) দায়ী করেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তিনি মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ হিসেবে বিভিন্ন লতাণ্ডগুল্ম ও অন্যান্য বস্তুর বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু যে একটি গ্রন্থ তাকে অমর করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ হিসেবে- সেটির নাম আলকানুন ফিততিব। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ এখনো পর্যন্ত আর দ্বিতীয়টি নেই।

কী আছে আলকানুন ফিততিবে : ৫ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত আলকানুন ফিততিবে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে যেন একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন।

আলকানুন ফিততিবের প্রথম খণ্ডে রয়েছে শরীরতত্ত্ব (চযুংরড়ষড়মু) ও স্বাস্থ্যতত্ত্ব (ঐুমরবহব), দ্বিতীয় খণ্ডে ৭৫০টি গুল্ম, পানীজ ও খনিজ ওষুধের বর্ণনা। এজন্য তিনি গ্রিক, রোমান, চীনা এবং ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সারনির্যাস সংগ্রহ করেন। তৃতীয় খণ্ডে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও একাধিক রোগ এবং সেগুলোর উপসর্গ (ঝুসঢ়ঃড়স), নির্ণয় (উরধমহড়ংরং), পূর্বাভাস (চৎড়মহড়ংরং) কারণতত্ত্ব (ঊঃরষড়মু) নিয়ে তিনি বিশদ আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি মাথা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে চোখ, কান, নাক, মুখ, দাঁত এভাবে নিচের দিকে নেমে চতুর্থ খণ্ডে বিশেষ কিছু রোগ যেমন: জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, ভয়, বেদনা, প্রদাহ, পচন, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাড়ের ভাঙন বা স্থানচ্যুতি, বিষক্রিয়া, ফোঁড়া, ঘা, চুল- নখণ্ডচামড়া বিভিন্ন রোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সর্বশেষ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র, বড়ি, পাউডার ও সিরাপসহ নানান প্রকারের ওষুধসামগ্রী।

মহীরুহের বিদায় : শেষ জীবনে ইবনে সিনা ইরানের ইস্পাহানে বসবাস শুরু করেন। এর মধ্যে একসময় হামাদান এবং ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। এ সময় ইস্পাহানের সম্রাট ইবনে সিনাকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেতে পারেননি তিনি। হামাদানের পথে রওনা করেন তিনি। হামাদানের সঙ্গে তার অনেক স্মৃতিবিজড়িত ছিল। এখানে এসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুখ আর সারেনি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে তিনি ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (৪২৮ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত