ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফেনী

দুই ভাই আন্দোলনে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেন মাসুদ

দুই ভাই আন্দোলনে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেন মাসুদ

কোটাবিরোধী আন্দোলন উত্তাল হয়ে পড়ে সারাদেশ। জুলাই এর শেষদিকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের এক দফা দাবি জানিয়ে চলমান আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে শহিদ সরওয়ার জাহান মাসুদ ও তার ভাই মাসুম আল সামির একসঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। কর্মসূচি পালনকালে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা আতর্কিত হামলা চালিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ফেনী কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী সরওয়ার জাহান মাসুদ (২১)’র নিথর দেহ ফেনীর সার্কিট হাউস রোড়ে অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থাকে, খবর পেয়ে তার আপন ছোট ভাই মাসুম আল সামীর ঘটনা স্থানে এসে উদ্ধার করে বড় ভাইয়ের প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতাল নিতে চাইলে তাকে বাধা দেয় আওয়ামী ক্যাডাররা। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে খুনিরা নির্দেশ দেয় রাতের মধ্যেই লাশ দাফনের। বুকে দুটি এবং হাতে একটি গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে যায় মাসুদের শরীর। তবে তখনও প্রাণে বেঁচেছিলেন তিনি।

শহীদের ছোট সামীর জানান, আমার ভাই বেঁচে ছিল, সময়মত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে সে প্রাণে বেঁচে যেত। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পথে গাড়ি থামিয়ে আমাদের বাধা দিয়েছিল। সেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দাগনভূঞা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মাতুভূঞা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন। ওই সন্ত্রাসী আমার ভাইকে বলেছিলেন, ‘সে তো রাজাকার। রাজাকার মরলে কিছু হয় না।

সামীর বলেন, সেদিন ভাইয়া আমার আগে আন্দোলনে অংশ নিতে মহিপালে যায়। আমি পরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। আমি মহিপাল ফ্লাইওভারের উপরে উঠি, ভাইয়া নিচে ছিল। এক পর্যায়ে যোহরের সময় হলে ছাত্র-জনতা মহাসড়কেই নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। এই সুযোগে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত চারদিক ঘেরাও করে গুলি করতে থাকে। ভাইয়ার বুকে দুইটি ও হাতে একটি গুলি লাগে। গুলির আওয়াজ শুনে আমি ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছিলাম। কেউ ধরছিল না।

পরে সেখানে থাকা একজন লোক ফোন ধরে বললেন ভাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন। ঘটনার নির্মমতার কথা উল্লেখ করে সামির বলেন, তাৎক্ষণিক আমি এবং আরও কয়েকজন মিলে ভাইকে উদ্ধার করে দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। কিন্তু পথিমধ্যে ফেনী-মাইজদী মহাসড়কের বেকের বাজার এলাকায় মামুনের নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে দেয়। এ খবর বাড়িতে জানানোর পর আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে ছুটে গেলে তাদেরও মারধর করে ওই সন্ত্রাসীরা। এরপরও তাদের হাতে-পায়ে ধরে দেরিতে হলেও গুলিবিদ্ধ ভাইকে নিয়ে হাজির করি দাগনভূঞা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসাকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উপজেলার পাকিস্তান বাজার এলাকায় আমাকে আবারও মারধর করা হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সামির আরও বলেন, তারপর লাশ পাঠানো হয় ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে। কিন্তু সেখান থেকে দ্রুত বাড়িতে নিতে চাইলেও বাধা দেওয়া হয়। পরে রাত ১টায় ভাইয়ার লাশ বুঝে পেলেও রাতের মধ্যেই লাশ দাফনের নির্দেশ দেয় খুনিরা। সামির বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই ভাইয়া সক্রিয় ছিলেন। ফেসবুকে লিখতেন এ সরকারের পতন খুব নিকটে। সেই থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারধর করবে বলে আমাদের হুমকি দিত। ভাইয়া আমাকেও সাহস দিতেন। আব্বু আমাদের নিষেধ করলেও দুইভাই মিলে বের হয়ে যেতাম আন্দোলনের উদ্যেশ্যে। সেদিন সকালে আম্মুর সঙ্গে পারিবারিক একটা বিষয়ে ভাইয়ার কথা হয়। পরে আব্বুর অজান্তে আন্দোলনে অংশ নিতে চলে যায় মহিপালে।

মাসুদের ফুফাত ভাই মো. মোশারফ হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ মাসুদকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আওয়ামী লীগের লোকজন বাধা দেয়। এছাড়া প্রত্যেকের মোবাইল কেড়ে নিয়ে ফেসবুক প্রোফাইল লাল কিনা চেক করে দেখেছিল তারা। এখনও ছেলে হারানোর বেদনা ভুলতে পারছেন না জেলার দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর মীর বাড়ির শহিদ সারওয়ার জাহান মাসুদের মা বিবি কুলসুম। ছেলের শোকে এখনও আহাজারি করেন তিনি। সন্তানহারা বিবি কুলসুম বলেন, আমার ছেলে মানুষের জন্য কাজ করতো। সামাজিক কাজে যুক্ত থেকে মানুষের উপকারে ব্যস্ত থাকত। তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলল। ছেলে আমার, তার বাবার সঙ্গে প্রবাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো।

তিনি বলেন, আমার বুকে ধনকে তারা মেরে ফেলেছে। অথচ, সে কারও ক্ষতি করেনি। পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ত, রমজান মাসে ২০ রোজার পর মসজিদে এতেকাফ করতো। এ ঘটনায় মাসুদের মা বিবি কুলসুম নিজে বাদী হয়ে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১৩৪ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

জানা যায়, মো. সরোয়ার জাহান মাসুদ ছিল তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। জন্মগ্রহণ করেন ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর। ২০২০ সালে সিলোনিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও পরে ২০২২ সালে দাগনভূঞা সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ফেনী সরকারি কলেজের বিএসএস প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছিলেন।

মাসুদের মেজ ভাই মাসুম আল সামির নিজ উপজেলার সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ও ছোট ভাই সাইম সুলতান পড়ছে মাদ্রাসায়। মাসুদের পিতা শাহজাহান টিপু দুবাই প্রবাসী। মা বিবি কুলসুম একজন গৃহিণী। মাসুদের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত