পিঠে, মাথায় ও পায়ে গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে যায় শহিদ ওয়াকিল আহমেদ শিহাবের (২০) শরীর। গত ৪ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অতর্কিত হামলায় পিঠে, মাথায় ও পায়ে গুলি লেগে লুটিয়ে পড়ে যায় সে।
জেলার মহিপাল সার্কিট হাউস রোড থেকে তাকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় সহযোদ্ধারা। এরমধ্যেই জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ায় সরে যায় সবাই। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পড়েছিল এ শহিদের নিথর দেহ।
সবদিক খোঁজাখুজির পর জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে থাকা লাশগুলো দেখছিলেন নিহতের ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম। প্রথম লাশটির মুখের কাপড় সরিয়ে দ্বিতীয়টির মুখঢাকা কাপড় সরাতেই ভাইয়ের লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই সেদিনের ভাই হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি তুলে ধরেন ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফতাব ভুঞা বাড়ির সৌদি প্রবাসী মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে সায়েম।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলেন, ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বাড়িতে এসে আম্মুর সঙ্গে দেখা করে শিহাব। আম্মু তাকে চুল কাটতে টাকা দিয়ে সেলুনে যেতে বলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ আম্মুর সঙ্গে কথা বলে বিদায় নেয় ভাইয়া। সেটিই ছিল আম্মুর সঙ্গে শেষ দেখা। আম্মুর সঙ্গে কথা বলে এক বন্ধুর সঙ্গে রাস্তার দিকে যায়। দুইজনে নাস্তা করে ভাইয়া সেলুনে যায়। এরপর ভাইয়ার কাছে এক বন্ধু ফোনকল করে জানতে চায় আন্দোলনে যাবে কি না। তখন ভাইয়া সেলুনে। বন্ধুর ফোন পেয়ে সেলুন থেকে বের হয়ে মহিপাল আন্দোলনে চলে যায়।
সায়েম বলেন, সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়। যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন ভাইয়ার সেই বন্ধু ফ্লাইওভারের উপরে চলে যায়, আর ভাইয়া সার্কিট হাউস রোডে ঢুকলে তার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। এতে ভাইয়ার মাথায়, পিঠে এবং পায়ে ৩টি গুলি লাগে। সায়েম বলেন, সেদিন দুপুরে আমি ভাত খাচ্ছিলাম। তখন আম্মু বললো শিহাব এত দেরি করছো কেন, তার খোঁজ নে। ভাইয়াকে অনেকবার ফোন দিলেও ধরেনি। ভাইয়া যেখানে কাজ করে সেখানেও খোঁজ নিই, ততক্ষণে তারা জানলেও আমাদের তখন কিছুই বলেনি।
বিকালে সবাই এসব বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখন একজন জানায় তিনি ফেনী জেনারেল হাসপাতালে আছেন।
আমরা ভেবেছি ভাইয়া কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে তাই দেরি হচ্ছে। তখনি আমার এক আত্মীয় ফোনে জানায় শিহাব গুলিবিদ্ধ। সায়েম বলেন, এরপর আমি এবং আমার চাচ্চু মিলে হাসপাতালে যাই। পথে কোনো গাড়ি ছিল না, অনেক ভোগান্তি হয়েছে যেতে। ভাইয়াকে যখন খুঁজছিলাম তখন জরুরি বিভাগের সামনে আরও ৫-৬টি লাশ পড়ে ছিল।
লাশ বুঝে নেওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিল, দেরি করলে লাশ গুম করে ফেলবে। এরপর তড়িঘড়ি করে একটা সিএনজি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। সেদিন আম্মু অজ্ঞান ছিল সারাদিন। নিজেকে দোষ দিচ্ছিল কেন চুল কাটাতে বলেছি। কিন্তু ভাইয়া চুল না কেটে আন্দোলনে গিয়ে শহিদ হয়। সবসময়ই মানুষের উপকারে কাজ করত শিহাব। রক্তদান কর্মসূচি, সামাজিক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সাথে লেগে থাকত সবসময়। ইচ্ছা ছিল পরবর্তীতে বিদেশ চলে যাবে। তাই মহিপাল প্লাজায় মোবাইল দোকানে মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ শিখছিলেন। ছেলের জন্য এখনও আহাজারি করছেন শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার। তিনি বলেন, ছেলে সবসময় আমার কাছাকাছি থাকত, সেদিনও আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে কিন্তু কে জানত না সেটিই ছিল শেষ দেখা। আন্দোলনে গিয়েছিল সে, খুনিরা তাকে মেরে ফেলল। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।
শিহাবের পিতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। এখন এই হত্যার বিচার নিশ্চিত করা রাস্ট্রের তথা সরকারের দায়িত্ব। শিহাব হত্যার বিচার চেয়েছেন তার এলাকাবাসীও।
দক্ষিণ কাশিমপুর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, শিহাব সবসময় ভালো কাজের সাথে যুক্ত থাকত। যে-কারও প্রয়োজনে সবার আগে দৌড়ে যেত। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এ ঘটনায় গত বছরের ২০ আগস্ট রাতে শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বাদী হয়ে ১৫১ জনের নামোল্লেখ ও আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ফেনী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এবং ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে যথাক্রমে প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বর আসামী করা হয়েছে। পরিবারে দুই সন্তানের মধ্যে বড় শহিদ শিহাব ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০২১ সালে জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে পরবর্তীতে স্থানীয় মহিপাল প্লাজায় মোবাইল মেকানিকের কাজ শিখছিলেন। তার ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম স্থানীয় একটি মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।