
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে মাছ ধরার চাঁই তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছে শতাধিক পরিবার। বর্ষা মৌসুমে চাঁইয়ের ব্যাপক চাহিদা। তাই বর্ষার আগমনি বার্তায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত নারী ও পুরুষেরা চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ফলে চাঁই তৈরিতে অনেকেই আর্থিকভাবে হচ্ছেন লাভবান এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখছেন অবদান।
জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে গ্রামবাংলায় নদী-খাল-বিল ইত্যাদিতে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয় এ চাঁই। বাঁশের শলা দিয়ে তৈরি এক ধরনের মাছের ফাঁদকে মাছ ধরার চাঁই বলে। মুলি ও মোড়ল দুই ধরনের বাঁশ দিয়েই এ চাঁই তৈরি করা হয়। মূলত এ শিল্পের বেশির ভাগ কারিগরই হলেন নারী। একটি মুলি বাঁশ দিয়ে সাধারণত ছোট মাছ ধরার চারটি চাঁই হয়, আর একটি মোড়ল বাঁশ দিয়ে কুচে, শিং, কই প্রভৃতি মাছ ধরার চাঁই হয় ২৫টি। চাঁই তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো বাঁশ। প্রথমে বিভিন্ন মাপে বাঁশের শলা তুলে সেগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর শুরু হয় চাঁই তৈরির কাজ। বিভিন্ন ধাপের পর একটি পরিপূর্ণ চাঁই তৈরি হয়। পানিতে মাছ চলাচল করতে করতে একসময় চাঁইয়ের ভেতরে ঢুকলে আর বের হতে পারে না। চাঁই খাল, বিল কিংবা ডুবে যাওয়া ফসলি ক্ষেতে পেতে রাখা হয়। যেখান থেকে দেশীয় প্রজাতির চিংড়ি, শোল, শিং, কই, খলিশা, পুঁটি মাছ ধরা পড়ে। তবে এখন বেশি পানিতেও ফাঁদ পাতার জন্য বড় আকারের চাঁই বানানো হয়, যাতে রুই-কাতলও ধরা পড়ে। বর্ষাকালে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বাঁশের চাঁই দিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা যায়, বিশেষ করে হোসেনপুরে গ্রামগুলোর খাল-বিল, নদী-নালায় ফাঁদ পেতে খুব সহজেই বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ শিকার করা হয়। সারা বছরই চাঁই তৈরি করে থাকেন কারিগররা। তবে বর্ষার ঠিক আগমুহূর্তে বিভিন্ন গ্রামে মাছ ধরার ফাঁদ চাঁই বানানোর ধুম পড়ে যায়। বিভিন্ন আকার ও আঙ্গিকে তৈরি মাছ ধরার এ ফাঁদগুলোর রয়েছে বাহারি নাম। যেমন- চাঁই, বুচনা, গড়া, চরগড়া, খুচইন ইত্যাদি। আবার চাঁইয়ের মধ্যেও রয়েছে নামের বিভেদ। যেমন- ঘুনি চাঁই, কইয়া চাঁই, বড় মাছের চাঁই, জিহ্বা চাঁই, গুটি চাঁই ইত্যাদি।
সরেজমিনে উপজেলার সাহেদল ইউনিয়নের উত্তর কুড়িমারা, আশুতিয়া, ঠাডা কান্দা, রহিমপুর, গলাচিপাসহ বিভিন্ন গ্রামে বর্ষা মৌসুমের আগমনে মাছ ধরার চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী ও পুরুষরা। তবে এ কাজে তাদের ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করে থাকেন। উত্তর কুড়িমারা গ্রামে পূর্বপুরুষ থেকে এ কাজে অনেকেই নিয়োজিত। ৭০ বছর ধরে চাঁই তৈরি করছেন কেরামত আলী। তিনি বলেন, এবছর প্রায় ২০০ চাঁই তৈরি করে বিক্রয় করেছি। প্রতি ১০০ চাই তৈরি করতে খরচ পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর তা বিক্রয় হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সে হিসাবে বছর শেষে লাভের খাতায় যোগ হয় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা।
আমার মতো এমন প্রায় ১ থেকে ২০০ পরিবার উত্তর কুড়িমারা, বঢ়ূয়া, দক্ষিণ পাড়া, আশুতিয়া, নামা পাড়ার লোকজন নিয়োজিত আছে। এ পেশায় থেকে দুই ছেলেকে ইটালিতে পাঠিয়েছি। বাপ-দাদার এ পেশাকে এখনও ধরে রেখেছি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এহসানুল হক জানান, এসব কুটির শিল্প কারিগরদের প্রণোদনা দিয়ে সাহায্য করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাহিদ ইভা জানান, কুটির শিল্প কারিগররা যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও উন্নত যুগোপযোগী মাছ ধরার যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারবে। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
যুগের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফাঁদের আকার, ধরন ও নকশায় পরিবর্তন হলেও এখনও জনপ্রিয়তা কমেনি মাছের এই চাঁইয়ের।