দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে রোডক্র্যাশের সংখ্যা। এমন অবস্থায় সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের সমন্বয়ে একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলে রোডক্র্যাশের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সিস্টেম ব্যবহার করে রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে দেশে ৫১১টি রোডক্র্যাশ হয়েছে। এতে ৪৮৩ জন নিহত আর ৫৬৬ জন আহত হয়েছেন। অথচ জাতিসংঘ স্বীকৃত ‘সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের (নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং রোডক্র্যাশ-পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থাপনা) সমন্বয়ে একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে রোডক্র্যাশের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব হয়েছে।
রোডক্র্যাশের সার্বিক হার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।
অথচ এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই কতটা আন্তরিক প্রশ্ন থেকে যায়। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য উন্নত দেশগুলো সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের (মাল্টিমডাল ট্রান্সপোর্টেশন, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও রোডক্র্যাশ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা) আলোকে নিজেদের আইনি ও নীতি কাঠামো প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নে সুফল পেয়েছে। তারপরও আমাদের বর্তমান আইনি ও নীতি কাঠামোতে এ দর্শন সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। দেশে সড়ক সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক হলে সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে রোডক্র্যাশ কমানো সম্ভব হয়েছে।
আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়কে পরিবহনের জন্য আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিমালা। তাই পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি এ আইনে সাম্প্রতিক সংশোধনীর সময়ে গতি নিয়ন্ত্রণ, হেলমেট ও সিটবেল্টের মতো কিছু বিষয় সংযোজন করা হলেও তা সড়কে রোডক্র্যাশের কারণে মানুষের মৃত্যু ও বড় ধরনের আঘাত থেকে রক্ষার করার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ২০১৮ সালে করা হয় সড়ক পরিবহন আইন; লক্ষ্য ছিল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো। তবে ছয় বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও সড়কে প্রাণহানি কমেনি। সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এজন্য সড়কে প্রাণহানি কমাতে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের জরুরি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর রোডক্র্যাশে ৩১ হাজার মানুষ মারা যায়। রোডক্র্যাশে স্থায়ী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন।
সড়ক পরিবহন আইনে সড়কের নিরাপত্তা প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। অথচ আমাদের দরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন, যেখানে পরিবহন ও চালকদের পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারীসহ সবার সুরক্ষার বিষয়টিকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হবে।
সড়কে নিরাপত্তা কেউ-ই দেখছে না। গাড়ির চালকের সিটবেল্ট থাকলেও নেই যাত্রীর, মোটরসাইকেলচালক যে হেলমেট ব্যবহার করছে, সেটিও আন্তর্জাতিক মানের কি না তা দেখা হচ্ছে না। সঙ্গে থাকা যাত্রীর হেলমেটের অবস্থা আরও খারাপ। গতিসীমাও মানা হয় না। এসব কারণে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
চারটি ধারায় জামিন অযোগ্য শাস্তির বিধান রেখে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। আইন পাস হওয়ার চার বছর পর ২০২২ সালে তৈরি হওয়া বিধিমালায় ১৬৭টি বিধির মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে বলা হয়েছে। তাও জোরালো নয়। বিধিমালা ১২৫-এ গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। সিটবেল্টের বিষয়েও বিধিমালায় স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। সিটবেল্ট কেমন হবে, কেমন সিটবেল্টের গাড়ি আমদানি করা যাবে, তাও বলা হয়নি এতে।
প্রাণহানি ও আহত হলে আইনে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা সহায়তার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হতাহতদের স্থায়ী পুনর্বাসন ও আইনি সুরক্ষার বিষয়ে কিছু নেই। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইনটি করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। কিন্তু আইনে পরিবহন কীভাবে চলবে, সেসব বলা হলেও উপেক্ষিত সড়ক নিরাপত্তা। চালকের সিটবেল্ট ব্যবহার করার কথা বলা হলেও সেটি আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে কি না সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। পাশাপাশি যেসব কারণে রোডক্র্যাশ হয়, সেগুলোকে রাখা হয়নি।
ডব্লিউএইচও বলছে, শুধু ৫ শতাংশ গতি নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব। সিটবেল্ট বাঁধলে মৃত্যুঝুঁকি কমে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সিটের ব্যবস্থা করলে ৫৪ থেকে ৮০ শতাংশ ঝুঁকি কমে। সঠিক মানের হেলমেট ব্যবহারে মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমে।
দুর্ঘটনা কমাতে হলে শুধু পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে নয়, আধুনিক সড়ক, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গতি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, সাধারণ পথচারীদের সচেতনতায় জোরালো পদক্ষেপ সংবলিত নিরাপদ সড়ক আইন দরকার। কিন্তু বিদ্যমান আইনে কেবল পরিবহনের বিষয়টি দেখা হয়েছে। আসলে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে দরকার নিরাপত্তা আইন। এজন্য দরকার বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরিবহন মালিক ও বিআরটিএসহ সবার আন্তরিকতা।
আমি মনে করি, সড়কে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের আলোকে নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত আলাদা আইন প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই নীতি নির্ধারণ পর্যায়ের সবার আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।
লেখক: অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন) রোড সেইফটি প্রকল্প, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন