ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শুক্র গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব বাস্তব নাকি কল্পনাপ্রসূত?

মো. তাহমিদ রহমান
শুক্র গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব বাস্তব নাকি কল্পনাপ্রসূত?

ফসফিন হচ্ছে একটি গ্যাস যা পৃথিবীতে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে ফসফরাসের সঙ্গে হাইড্রোজেনের মিলন ঘটিয়ে এই গ্যাস তৈরি করে। একটি ফসফরাস পরমাণু আর তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে ফসফিন গ্যাসের প্রতিটি অনু তৈরি হয়। সৌরজগতে সূর্যের দ্বিতীয় নিকটতম গ্রহ ভেনাস বা শুক্রের মেঘমালার মধ্যে ফসফিন গ্যাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করার পর নড়েচড়ে বসেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এত বেশি মেঘ যে গ্রহটা যেন সাদা তুলোয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো তাই বিন্দু পরিমাণ আলোক রেখা তার ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। সাদা মেঘের আড়ালে কী আছে তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাজার বছর ধরে গবেষণা করে চলেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা শুক্র গ্রহ হলো অবিরাম বৃষ্টি ধারার কূলকিনারাহীন এক মহাসাগর। আবার অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মতে পৃথিবীর মতোই সেখানে, মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল, জন্তুজানোয়ার সব আছে।

শুক্র গ্রহে টেলিস্কোপে শুধু দেখা যায় সাদা মেঘের পাহাড়। মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে এলেন বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অতি সংবেদনশীল বেতারযন্ত্র ও বিশাল থালার আকারের অ্যারিয়ালের সাহায্য বিশেষ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে বিভিন্ন বেতার তরঙ্গ সংগ্রহ করলেন শুক্র গ্রহ থেকে। বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই বেতার তরঙ্গগুলো লাউড স্পিকারের মাধ্যমে শব্দে রূপান্তর করে আলাদা আলাদাভাবে চিনতে শিখেছেন।

যার ফলে তারা দূর থেকে কোন জিনিসের তাপমাত্রা মাপতে পারেন। আর এভাবেই শুক্র গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত বেতার-তরঙ্গগুলো লাউড স্পিকারের মাধ্যমে শব্দে রূপান্তর করে তারা জানালেন শুক্র গ্রহের মেঘ ঠান্ডা, কিন্তু সেই মেঘের নীচেই আছে প্রায় গনগনে লাল শক্তপৃষ্ঠতল।

শুক্র গ্রহ থেকে যথাযথ তথ্য প্রাপ্তির জন্য বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা স্পেসস্টেশন স্থাপনের চেষ্টা করেন। এই স্টেশনগুলোর প্রথম দুটি ব্যর্থ হলেও তৃতীয়টি শুক্র গ্রহে পৌঁছাতে সক্ষম হয়; কিন্তু এর সাহায্যে কোনো সংবাদ বা তরঙ্গ পাওয়া যায়নি। স্টেশনগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করে পুনরায় প্রেরণ করা হয়। সেগুলো সফলভাবে শুক্র গ্রহে গিয়ে সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ধীরে ধীরে রহস্যময় মেঘের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। স্টেশনগুলোর শুক্র গ্রহে নামার সময় যা যা উপলব্ধি করে, সেগুলো অবিরামভাবে বেতারে তরঙ্গ প্রেরণ করতে থাকে। বেতারে প্রেরিত তরঙ্গগুলো তাপমাত্রায় রূপান্তরিত করে বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীগণ প্রমাণ করলেন যে শুক্র গ্রহের বায়ুসমুদ্রের তলদেশের তাপমাত্রা ৪৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যা সত্যিকার অর্থেই একটা জলন্ত চুল্লি।

বেতারে প্রেরিত তরঙ্গগুলো বিশ্লেষণ করে বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা জানাল যে শুক্রে দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্মে সর্বদা এই গরম থাকে। সেখানকার বায়ু, আমাদের পৃথিবীর বায়ুর চেয়ে কয়েক ডজন গুণ ঘন এবং তার উপাদানগুলোও সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর পর ধীরে ধীরে মহাকাশচারীরা একসময় শুক্রের পিঠে অবতরণ করলেন, তারা দেখলেন যে সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য একঘেয়ে বিবর্ণ পাথুরে মরুভূমি। বাতাস ঘোলাটে, কিন্তু তারা অনুভব করলেন যে গ্রহটি পুরোপুরি মৃত জগৎ নয়। সেখানে ধীরে ধীরে বয়ে চলা বায়ুকে ঠিক বাতাস বলা যায় না। পৃথিবীর বাতাস যেমন ক্ষিপ্র, দমকা, অস্থির প্রকৃতির। কিন্তু সেখানের বাতাস যেন একটা বিশাল নদীর বয়ে চলা পানির মতো শান্ত গম্ভীর। ধীরে সুস্থে একই দিকে বয়ে চলা বাতাসে লক্ষ্য করলে এমন কিছু জিনিস এখানে চোখে পড়বে যেগুলো শান্ত ভাবে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।

মহাকাশচারীরা আবিষ্কার করল শুক্রের বাতাস যতোটা গরম এর পৃষ্টতল যতোটা উত্তপ্ত, পৃষ্টতলের পাথরের ১ মিটার নিচে ততোটা উত্তপ্ত নয়। তার মানে, অগ্নিতপ্ত পরিবেশ বলতে আমরা এই গ্রহের যে অবস্থাটা ধারণা করছি সেটা শুক্রের উপরকার একটা পাতলা স্তর মাত্র। গভীরে অনেকটা ঠান্ডা। মহাকাশচারী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা দেখলেন সেখানে তাপমাত্রা মোটামুটি ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। শুক্রের বাতাস যেন একটা বিশাল নদীর বয়ে চলা পানির মতো শান্ত গম্ভীর।

ধীরেসুস্থে একই দিকে বয়ে চলে। মহাকাশের অন্যতম গ্রহ পৃথিবীর জলময় মহাসাগরের নিচেও তেমন আরামের কিছু নেই। সেখানে ঠান্ডা, চির আঁধার। কিন্তু মহাসাগরের অধিবাসীদের কিন্তু মহাসাগরের তলায় ঘুরে বেড়াতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সেখানে বাঘ বাস করে না,মানুষও বাস করে না। এমন কোনো জীব বাস করে না যাদের পায়ের তলায় শক্ত মাটির দরকার হয়। বাস করে মাছেরা।

সেই মৎস্যকূলের তলা কাকে বলে কখনও জানারই দরকার হয়নি। সারা জীবনই তারা সাঁতার কাটে, পানির উপরিভাগের কাছাকাছি দিয়ে চলে। ধারণা করা হচ্ছে শুক্র গ্রহের বায়ুসমুদ্র অনেকটা পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরেরই মতো। এমনও তো হতে পারে শুক্র গ্রহের বায়ুসমুদ্রের উপরিভাগের কাছাকাছি সাঁতরে সাঁতরে সেখানে কোনো জীবন বসবাস করছে। মার্কিন ও রাশিয়ান স্বয়ংক্রিয় স্টেশনগুলো শুক্রে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিটি স্টেশন থেকে আশ্চর্য এই গ্রহটির প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আসছে। শুক্র গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে তাই বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে।

২০২০ খ্রিস্টাব্দে, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেন গ্রিভস ও তার দলের গবেষণায় শুক্রের মেঘমালায় ফসফিন গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। পৃথিবীতে এই গ্যাস সাধারণত জীবাণু দ্বারা উৎপন্ন হয়, যা অক্সিজেন বিহীন পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। শুক্রের মতো অতি উত্তপ্ত ও অ্যাসিডিক পরিবেশে ফসফিনের উপস্থিতি জীবনের ইঙ্গিত বহন করে। শুক্রে মেঘস্তরের ৪৮০৬০০ কিমি উচ্চতায় তাপমাত্রা ৩০-২০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং চাপ ১ অ্যাটমস্ফিয়ার পর্যন্ত, যা পৃথিবীর মেঘস্তরের মতো। পায়োনিয়ার ভেনাস এবং ভেনাস এক্সপ্রেস মিশনের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রে এক সময় মাঝারি গভীরতায় প্রায় ৩০ ফুট সমুদ্র ছিল।

এই সামুদ্রিক পরিবেশ অনেক বিলিয়ন বছর স্থায়ী ছিল সুতরাং জীবন আরম্ভ হওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট সময় ছিল। পৃথিবীতে একাধিক এক্সট্রিমোফাইল প্রাণী আছে, যারা জ্বালানি হিসাবে সালফার বা লোসহীন রাসায়নিক চক্র থেকে শক্তি আহরণ করে।

শুক্রের মেঘস্তরে কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার- এই ছয় উপাদান পাওয়া যায়, যা সমস্ত জীবাণুর কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয়। শুক্রের মেঘমালায় সূর্যালোকের উপস্থিতি জীবাণুদের জন্য শক্তির উৎস হতে পারে।পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি। এই পতঙ্গগুলো বিভিন্ন পরিবেশে বাস করে এবং তাদের জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে। মানুষ বা অন্য প্রাণীর যেমন কাজের মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে হয়।

বায়ুসমুদ্রে পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিজেকে সামলাতে পারে; কিন্তু মাঝে মাঝে তাকেও তো বিশ্রাম নিতে হয়। রেশমের ফেঁসোর ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তারা ধূলিকণার মতো ভেসে থাকতে পারে, এর জন্য ডানা ঝাপটানোর পর্যন্ত দরকার হয় না। যেহেতু শুক্র গ্রহের মেঘরাশির ওপরের দিকে গরম নেই। সেখানকার বায়ু প্রায় পৃথিবীর উপরিভাগের বায়ুর মতো ঘন।

তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ফেঁসোর মতো ছোট ছোট কীটপতঙ্গের অস্তিত্ত্ব শুক্র গ্রহে থাকা অসম্ভব নয়। শুক্র গ্রহে জীবনের উপস্থিতি এখনও শতভাগ নিশ্চিত নয়, তবে ফসফিনের আবির্ভাব, মেঘস্তরের অনুকূল পরিস্থিতি, অতীত জলের বৈশিষ্ট্য, রাসায়নিক উপাদান ও জীব-জীবনের সম্ভাব্য চক্র সব মিলিয়ে জীবন থাকার সম্ভাবনা দিনদিন গুরুত্ব পাচ্ছে। আমি স্বপ্নবিলাসী মানুষ তাই কল্পনা করি শুক্র গ্রহকেও মানুষ গোছগাছ করে বসবাসের উপযোগী করে তুলবে। বায়ুমণ্ডলে ভাসতে ভাসতে বিভিন্ন অনুজীব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করবে।

শুক্রের বায়ুমণ্ডলে স্বচ্ছতা আসবে। মেঘ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরবে। শুক্রের বুকে বয়ে চলবে নদী, সরোবর, সমুদ্র। আর্দ্র জমিতে লোকে বীজ বুনবে। বনজঙ্গল গজাবে। বনজঙ্গল বায়ুকে অক্সিজেন জোগাবে, ফলে বায়ু, জীবজন্তু ও মানুষের নিঃশ্বাস গ্রহণের উপযোগী হয়ে উঠবে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠবে নতুন এক জীববৈচিত্র্য। আপাতত এটাকে নাহয় কল্পনাবিলাসই ধরে নিলাম।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত