ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গোলক ধাঁধায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি

অলোক আচার্য
গোলক ধাঁধায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি

ইউক্রেন এখনও রণক্ষেত্রে রাশিয়ার মোকাবিলা করছে। কিন্তু কার্যত ইউক্রেন অনেকটাই ব্যাকফুটে এবং এখন রাশিয়া সামনে অবস্থান করছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউক্রেনের চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া জেলেনস্কির জন্য ছিল কঠিন ব্যাপার। একটি মানসিক অস্বস্তি¡ এবং সেটি বজায় রেখেই এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না জেলেনস্কির হাতে। এই যুদ্ধের শুরুতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। কারণ রাশিয়ার সামরিক শক্তির তুলনায় ইউক্রেন যথেষ্ট পেছনে ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মনোভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসা রাশিয়ার জন্য পথটাকে দুর্গম করে তুলেছিল। অন্তত জো বাইডেন ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত ইউক্রেন ভালো সুবিধা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে। এখন কার্যত যুদ্ধ এক পক্ষীয়। ইউক্রেন বহুকিছু হারিয়েছে।

এখনও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। রাশিয়া তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছে এই যুদ্ধে। ইউক্রেনের এলাকা দখল করা, পাশ্ববর্তী দেশগুলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিণতির কথা, ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের কথা এবং সামগ্রিকভাবে মিত্র দেশগুলো কে কতটা কাজে আসতে পারে, সেই হিসাব করতেই হবে। ইউক্রেন নিজের জমি হারিয়েছে আবার ট্রাম্পের সঙ্গে খনিজ চুক্তি করতে এক রকম বাধ্য হয়েছে। এখন দরকার একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি যা বেশ কিছুদিন ধরেই ঝুলে আছে। এখন যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্তত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথায় এরকম আভাস পাওয়া গেছে। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে ঠিক কবে বা কখন এই যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হবে, সেটি ঠিক নিশ্চিত নয়। এটা শুধু একটা সম্ভাবনা মাত্র। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। কারণ রাশিয়া এখন শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং যুদ্ধবিরতি তখনই কার্যকর হবে যখন রাশিয়ার স্বার্থ ঠিক থাকবে। আলোচনার আভাসের মধ্যেই ইউক্রেনে ব্যাপক আকারে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এই হামলার পরপরই অবশ্য ট্রাম্প কিছুটা নাখোশ হয়েছেন। যখন যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে, তখন এই হামলা যুদ্ধবিরতিকে নিশ্চিতভাবেই বিলম্বিত করবে।

ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন- এমনটাই কথা ছিল নির্বাচনের আগে থেকেই। তবে সেই পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চেষ্টা করছেন যুদ্ধ বন্ধের। তবে বন্ধ করার থেকে যুদ্ধবিরতিতে এখন বেশি মনোযোগী যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুদ্ধ এখনও কতটা দরকার সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যুদ্ধ চলছে এক পাক্ষিক। যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়ার সঙ্গে আলাপ করছেন। ইউক্রেনও কিছুটা নরম। তবে কাজটা ঠিক পরিকল্পনা মতো হচ্ছে না। একই সঙ্গে রাশিয়াকে থামানো এবং ইউক্রেনের স্বার্থ রক্ষা করা যে কঠিন হবে সে তো জানা ছিল। ইউক্রেনকে চাপে ফেলে বা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পরাজিত করে যুদ্ধ বন্ধ করতে জোর দেওয়ার যে কৌশল সেটা ইউক্রেনকে মনোযোগী হতে হয়েছে। বাইডেন আমলের ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিত্রদেশগুলোর ওপর হামলা হলে তাদের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন যেভাবে এগিয়েছে, এখন সেভাবে সাহায্য করবে কি না, সেটাও প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে। এখানে প্রশ্ন হলো- যুদ্ধ যদি বিরতিও থাকে তাহলেও সেটা কতদিন থাকবে? বিরতি শেষে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হওয়ার শঙ্কা প্রথম থেকেই ছিল। গত বছর প্রকাশিত- আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিংকট্যাংক গ্লোবসেক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য ফল পর্যালোচনা করেছে। সেটাতে সবচেয়ে বেশি যা উঠে এসেছে, তা হলো ২০২৫ সালেরও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে, যাতে দুপক্ষেরই প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটবে এবং ইউক্রেন মিত্রদের অস্ত্র সহায়তার ওপর নির্ভর করে থাকবে।

আর দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফল হলো- বিশ্বের অন্যান্য অংশেও সংঘাত বাড়বে, যেমন মধ্যপ্রাচ্য, চীন-তাইওয়ান এবং বলকানদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা ছড়াবে। আরও যে দুটি সম্ভাব্য ফলের কথা উঠে এসেছে, যেগুলোর সম্ভাবনা খুবই সামান্য, তার একটা হলো ইউক্রেনে সামরিক দিক থেকে কিছুটা অগ্রসর হবে; কিন্তু যুদ্ধে শেষ করার মতো পরিস্থিতিতে যেতে পারবে না। অথবা ইউক্রেনের মিত্রদের সমর্থন ফুরিয়ে আসবে এবং তারা একটা সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিংকট্যাংক গ্লোবসেক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য ফল পর্যালোচনা করেছে। সেটাতে সবচেয়ে বেশি যা উঠে এসেছে, তা হলো ২০২৫ সালেরও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে, যাতে দু’ক্ষেরই প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটবে এবং ইউক্রেন মিত্রদের অস্ত্র সহায়তার ওপর নির্ভর করে থাকবে। ইউক্রেন এখন কার্যত চাপে রয়েছে। নিজ দেশের ভেতরেও যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ রয়েছে। এত দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চলার ফলে দেশটিতে মানবিক সংকটও দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এ কথা সত্যি যে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুতিনের যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সেটি কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর দীর্ঘায়িত হওয়ার রহস্য কোনো কৌশল হতে পারে। ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির সম্পর্কের শীতলতার বিপরীতে ট্রাম্পের রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের আভাস, ইউক্রেনের মূল্যবান খনিজের উপর কিছুটা অধিকার স্থাপন এবং আরও কিছু শর্তে বন্ধ হতে পারে এই যুদ্ধ। যদিও এই যুদ্ধ বন্ধ হলেও এই অঞ্চলের যুদ্ধ কি আদৌ শেষ হচ্ছে? গণমাধ্যমের আভাস তো বলছে ভিন্ন কথা। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিংকট্যাংক গ্লোবসেক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য ফল পর্যালোচনা করেছে। সেটাতে সবচেয়ে বেশি যা উঠে এসেছে, তা হলো- ২০২৫ সালেরও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত এবারের প্রতিপক্ষ পুবের প্রতিবেশী ন্যাটোর নতুন বন্ধু ফিনল্যান্ড। দুই দেশের মাঝে প্রায় ১,৩৪০ কিলোমিটার সীমানা। দীর্ঘ এ সীমান্তজুড়ে রাশিয়া চুপিসারে গড়ে তুলছে নতুন ঘাঁটি। মোতায়েন করছে সেনা। আধুনিকায়ন শুরু করেছে সামরিক অবকাঠামোগুলোতেও। সম্প্রতি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে প্রস্তুত, অন্যদিকে ফিনল্যান্ডের সাম্প্রতিক ন্যাটো অর্ন্তভুক্তি-সবকিছু মিলিয়ে রাশিয়া আগামীর সংঘর্ষের মানচিত্র আঁকছে ইউরোপের উত্তরের এ সীমান্তেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ যদি থেমেও যায়, রাশিয়ার বাহিনী তখন এই সীমান্তে আরও বড় আকারে মোতায়েন হতে পারে। আর সেটাই হতে পারে এক নতুন সংঘর্ষের সূচনা। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দেয় ফিনল্যান্ড। এরপর থেকেই সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ এবং বিমানঘাঁটি সংস্কারের কাজ শুরু করেছে রাশিয়া। রাশিয়া মনে করে, ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান তাদের ঐতিহ্যবাহী কৌশলগত ভারসাম্যকে বিপন্ন করেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফিনল্যান্ড সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরের কামেনকা অঞ্চলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০টির বেশি সেনা তাঁবু স্থাপন করেছে। যা প্রায় ২ হাজার সেনার আবাসন সক্ষমতার জন্য যথেষ্ট। এখানে প্রশ্ন হলো- এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলেও এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে অঞ্চলটি। কারণ এখন যুদ্ধ ফিনল্যান্ডের সাথে হবে না, হবে ন্যাটোর সাথে। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য দেশ না হলেও ফিনল্যান্ড সদস্য। আর সদস্য দেশের উপর আক্রমণ হলে সেটি ন্যাটোর উপর আক্রমণ হিসেবে ধরা হয়। যুদ্ধে অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে এবং জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। যুদ্ধ যদি বন্ধও হয় তাহলেও এসব মেরামত করতে দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থের। সেই অর্থ ঠিক আসবে বিভিন্ন সাহায্য থেকে। আপাতত দৃষ্টি রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধবিরতির দিকে। ইউক্রেনের মিত্র হিসেবে যারা পরিচিত সেই দেশগুলোর উচিত হবে, অতিদ্রুত একটি সমাধানের দিকে যাওয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত