বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার সঙ্গে সমান্তরালে একটি অদৃশ্য স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, সেটি হলো দুর্নীতি। এই দুর্নীতি কেবল আর্থিক নয়, এটি নৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক। বহুবছর ধরে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভেতরে, বাইরে ও মাঝখানে এক ধরনের দুর্নীতির অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, যা এতটাই সুশৃঙ্খল যে সেটিকে ‘দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বলা চলে। এই অর্থনীতি এমন এক ছকে গড়ে উঠেছে, যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়িক স্বার্থ ও প্রশাসনিক দুর্বলতা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে।
যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রকার দুর্নীতি ও দ্বিচারিতায় জর্জরিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রশ্নটি ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে, তা হলো, এই দুর্নীতির শেকড় কতটা গভীরে এবং কোথা থেকে আসে এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা? দুর্নীতি আজ আর শুধুমাত্র টেন্ডারবাজি, কমিশনখোরি কিংবা ব্যাংক লুটপাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি হয়ে উঠেছে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে রয়েছে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সুপরিকল্পিত অংশগ্রহণ এবং দেশের অভ্যন্তরে তথাকথিত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের নির্মম ভণ্ডামি।
বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খেলা এখন আর অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ইন্টেলিজেন্স ও কূটনৈতিক শক্তির মাঠ। দুর্নীতি, বিশেষ করে বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পে অর্থপাচার, কমিশন ভাগাভাগি অথবা সরকারি অর্থ বিদেশে পাচার, এসব কর্মকাণ্ডে বহু ক্ষেত্রেই বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন এজেন্ডা থাকতে পারে।
বিশেষত কিছু আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতির মামলার তথ্য ব্যবহার করে দেশীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে থাকে। কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে হঠাৎ করে ‘ফাঁস’ হয়ে যাওয়া তথ্য, যেমন বিদেশে অর্থপাচার, গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বা অবৈধ সম্পদ- প্রথমে উঠে আসে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়, তারপর সেটি দেশীয় তদন্তের আলোচনায় আসে। প্রশ্ন হলো, এসব তথ্য কি হঠাৎ করেই আবিষ্কৃত হয়, নাকি পরিকল্পিতভাবে ফাঁস করা হয় একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জ্বালানি।
ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রান্তে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দুর্নীতির শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ক্ষমতা যখন গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তা জবাবদিহিমূলক নয়, বরং একচ্ছত্র হয়ে ওঠে। এই ধরনের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় অর্থ, আনুগত্য ও প্রভাবের। আর এই তিনটি জিনিসই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তারা প্রশাসন, পুলিশ, আইনব্যবস্থা এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও নিজেদের লোক বসিয়ে দেয়। এদের কাজ সেবা দেওয়া নয়, বরং গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা ও অর্থ সংগ্রহ।
টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পের ‘কমিশন’, এসব হয়ে ওঠে ক্ষমতায় টিকে থাকার অর্থনৈতিক জ্বালানি। দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তাতে দেশের অভ্যন্তরের নেতাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ‘দেশপ্রেম’, ‘উন্নয়ন’, ‘স্বাধীনতা’ বা ‘জনগণের অধিকার’, এসব শব্দকে যারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন, তাদের অনেকেই আড়ালে বিদেশি দূতাবাসের বৈঠকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান, এবং নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে গোপন আঁতাত করেন।
একের পর এক সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতা, হঠাৎ কোনো দলের নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন, কিংবা নির্বাচনকে ঘিরে অস্বচ্ছ চুক্তিগুলোর পেছনে সেই ‘অদৃশ্য হাত’-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় স্বার্থের কথা বলে যারা মঞ্চ গরম করেন, তারাই বৈশ্বিক শক্তির কাছে দেশের গোপন তথ্য বা অর্থনৈতিক রূপরেখা তুলে ধরে। আমরা অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দুর্নীতির জন্য দায়ী করি, কিন্তু প্রশাসনিক আমলারা এই ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশীদার। বহু উচ্চপদস্থ আমলা তাদের পদ ব্যবহার করে যে ধরনের সম্পদ, প্রভাব ও সুযোগ অর্জন করেন, তা কেবল ‘ভুল’ নয়, অনেক সময় তা রাষ্ট্রবিরোধী।
দুর্নীতির রাজনীতিতে আমলারা দুইভাবে জড়িত- এক. রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে কাজ করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন; দুই. নিজেরাও ক্ষমতার এক স্তম্ভ হিসেবে লাভবান হন। ফলে এই গোষ্ঠীটিও পর্দার আড়ালে দুর্নীতির একটি মূল স্তম্ভ। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থপাচার কেবল ব্যক্তিগত লাভ নয়, এটি একটি বড় ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং চেইনের অংশ। অনেক নেতা বা প্রভাবশালী কর্মকর্তা যখন বিদেশে অর্থপাচার করেন, তখন তাদের সেই দুর্বলতা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার নিকট একটি ‘তথ্য সম্পদ’ হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তীতে তাদের দিয়ে অনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রভাবশালী চুক্তি স্বাক্ষর, কিংবা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড করানো হয়। দুর্নীতির প্রমাণ ফাঁসের ভয় দেখিয়ে এসব ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। অর্থাৎ, একজন দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা কেবল জাতির সম্পদ লুণ্ঠন করেন না, তিনি গোটা রাষ্ট্রকেই জিম্মি করে ফেলেন। বিদেশি শক্তির প্ররোচনায় জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দশকে এক ধরনের ‘করণিক পুঁজিপতি’ তৈরি হয়েছে, যারা মূলত ব্যবসায়ী মুখোশধারী আমলা, দলীয় নেতা কিংবা সিন্ডিকেটভিত্তিক ঠিকাদার। এরা ব্যাংক লুট করে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা নেয়, ভূমি দখল করে, আর রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ব্যবসা ফাঁপিয়ে তোলে। এদের অনেকেই কর দেয় না, ঋণ খেলাপি, কিন্তু ভিআইপি মর্যাদা ভোগ করে। ব্যাংকিং খাতের একাধিক কেলেঙ্কারির পেছনে এই সিন্ডিকেটের ভূমিকাই মুখ্য।
দুর্নীতিকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিণত করতে হলে বিচারহীনতা সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। বাংলাদেশে অনেক বড় দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে আসে, মামলা হয়, আলোচনাও হয়, কিন্তু শাস্তির নজির প্রায় নেই। এমনকি কিছু ঘটনায় অপরাধীকে পুরস্কৃত করাও দেখা যায়। দুদক বা অন্যান্য সংস্থাগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেছে, কারণ তারা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারে না। ফলে দুর্নীতি আর অপরাধের মধ্যকার সীমারেখা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।
যেখানে জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয় না, সেখানে জনগণের স্বার্থরক্ষা দুর্বল হয়। বাংলাদেশে একাধিক নির্বাচনে অংশগ্রহণহীনতা, ভোট ডাকাতি ও দলীয় প্রশাসনের অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের ব্যবস্থায় সরকার জবাবদিহিমূলক থাকে না, আর প্রশাসনও হয়ে পড়ে দলীয়। ফলে ‘জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠে ‘এক গোষ্ঠীর লুণ্ঠনের ক্ষেত্র’।
দুর্নীতির এই অর্থনীতি গণতান্ত্রিক কাঠামোর অভাবে আরও জটিল আকার ধারণ করে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, দুর্নীতিকে সমাজে এখন অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঘুষ না দিলে চাকরি হয় না, কমিশন না দিলে ফাইল চলে না, পরিচিতি না থাকলে সেবা পাওয়া যায় না, এই বিশ্বাস আমাদের নৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। যখন দুর্নীতি আইনের ব্যত্যয় না হয়ে জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, তখন তা এক প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে রূপ নেয়। এটি তখন অর্থনীতির মতোই সুসংগঠিত, ধারাবাহিক এবং টেকসই, যা কি না ভয়ানক।
সব সাংবাদিক বা গণমাধ্যম দুর্নীতিপরায়ণ না হলেও কিছু মিডিয়া দুর্নীতিকে ঢেকে রাখার, সাদা করার বা প্রতিপক্ষকে কালো চিত্রায়ণের কাজে ব্যবহৃত হয়। মালিকানা কাঠামো রাজনৈতিক হলে মিডিয়া প্রভাবকও হয়ে ওঠে দুর্নীতির অংশীদার। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা একদিকে দুর্নীতিতে জর্জরিত জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে নেতাদের দেশপ্রেমের ভণ্ডামিতে প্রতারিত হচ্ছে। একেক সরকারের সময় একেক মহাপরিকল্পনার কথা বলা হলেও, সেসব প্রকল্পের টাকাগুলো কোথায় যায়, তার কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা থাকে না।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রচারণা চললেও, তার বাস্তব রূপ সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না। এখন সময় এসেছে এই ধোঁয়াশা ভেদ করার। প্রয়োজন এক বিকল্প রাজনৈতিক চেতনা, যেখানে রাজনীতি হবে জনকল্যাণকেন্দ্রিক, স্বচ্ছ এবং তথ্যনির্ভর। জনগণকে বুঝতে হবে, কেবল ‘চেহারা’ বদলালেই রাজনীতি বদলায় না; দরকার হচ্ছে কাঠামোগত পরিবর্তন এবং একটি কঠোর জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। বাংলাদেশ আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে।
দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত একসঙ্গে মিলে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি নষ্ট করছে। যারা ক্ষমতায় আছে, কিংবা যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, দুই পক্ষেই দুর্নীতির দায় রয়েছে। বিদেশি সংস্থার ছত্রছায়ায় রাজনীতি চর্চা করে কেউ কখনো স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না। গণতন্ত্রের নামে এই ভণ্ডামি ও বাণিজ্যিক রাজনীতি যদি চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া হবে একটি চরম অনিশ্চিত ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র। এজন্য জরুরি, একটি গণসচেতন, তথ্যভিত্তিক এবং নৈতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেওয়া, যেটি দুর্নীতিকে শুধুই অপরাধ নয়, জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির দায় কেবল একজন বা একটি গোষ্ঠীর নয়, এটি একটি সমন্বিত ক্ষমতা কাঠামোর পচনের ফলাফল। তবে এর মানে এই নয় যে সবাই সমান অপরাধী। বরং মূল দায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, প্রশাসনিক অসততা এবং দুর্বল নাগরিক চাপের। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতির বাস্তবতা একটি গভীর রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে রয়েছে স্বার্থের সংঘাত। কিন্তু এই বাস্তবতা চিরন্তন নয়। যদি জনগণের চেতনা জাগে, যদি নেতৃত্বে থাকে সততা ও সাহস, যদি প্রশাসন হয় জনমুখী, তাহলে দুর্নীতির এই অন্ধকার চক্র ছিন্ন করা সম্ভব। এই জন্য প্রয়োজন এক সাহসী ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন, যা শুধু রাস্তায় নয়, নীতিতে, শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটাবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট