ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্মার্টফোন আসক্তি : শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ সবাই শিকার

মাইফুল জামান ঝুমু
স্মার্টফোন আসক্তি : শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ সবাই শিকার

প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে স্মার্টফোন হয়ে ওঠেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমাদের চলাফেরায়, কথাবার্তায় সবকাজের অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে স্মার্টফোন। কিন্তু স্মার্টফোন যেমন আমাদের জীবনযাপনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তেমনি এর অতিরিক্ত ব্যবহার সমাজে ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব। বর্তমানে স্মার্টফোন আসক্তি সমাজের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ সবাই আজকে স্মার্টফোনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আজকাল স্মার্টফোন ছাড়া ব্যক্তিকে ‘স্মার্ট’ হিসেবেও গণ্য করা হয় না। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় এখন রাত ১২টা বাজলে সন্ধ্যা হয় আর ভোর ৩টা বাজলে হয় মধ্যরাত। আবার বেলা ১০টা বাজলে হয় সকাল। আজ থেকে এক যুগ আগেও মানুষ ঘুম থেকে ওঠেই যেখানে খবরের কাগজে বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ বুলাত, বর্তমানে তা মোবাইলের নোটিফিকেশনেই নিবদ্ধ হয়ে গেছে। আমরা সবাই এখন নোটিফিকেশনের কাঙাল। ঘুম থেকে উঠে মোবাইলের নোটিফিকেশন চেকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। একবার নোটিফিকেশন না দেখলেই যেন মনে হয় কী একটা মিস হয়ে গেল। আর খবরের কাগজ এখন হয়ে ওঠেছে স্মার্টফোনহীন বয়োঃবৃদ্ধদের সময় কাটানোর মাধ্যম।

একজন শিশু জন্মগ্রহণের ৫-৬ মাস পরই আমরা অবলীলায় তাকে মোবাইল ফোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। শিশু কান্না করলে এখন আমরা তার চোখের সামনে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন ভাসিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। এখন আর কোনো শিশুকে চাঁদমামা দেখিয়ে কিংবা ঠাকুরমার ঝুলির গল্প বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়াতে হয় না। শিশু খেতে না চাইলে তার হাতে মোবাইলফোন ধরিয়ে দিলেই হয়। কার্টুন, গেইমস দেখিয়ে এখন তার খাওয়ার কাজ সেরে ফেলা হয়। আগেকারদিনে শিশুরা মায়ের মুখের ভাষা শুনে তাদের মাতৃভাষার সাথে পরিচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে শিশুদের আমরা মোবাইলফোনের উপর এমনভাবে নির্ভর করাচ্ছি যে তাদের এখন ঠিকভাবে মাতৃভাষার চর্চা করাতেও অপারগ হচ্ছি। বিভিন্ন ভাষার কার্টুনস, গেইমস দেখে এখন তারা অল্প বয়সেই বিভিন্ন ভাষা লদ্ধ করে বসে। কিন্তু কোনটা তাদের মাতৃভাষা সেটা তাদের এই ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না। আমাদের সমাজে এমন অনেক শিশু আছে, যারা ছোটবেলা থেকেই কার্টুন দেখে এমন সব ভাষা শিখেছে যা তাদের অভিভাবকরাও বুঝে না। মা-বাবার কাছে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে গেলেও বাবা-মা তা বুঝতে অপারগ। এভাবে যখন একটি শিশু কাউকে তার মনের ভাব বুঝাতে ব্যর্থ হয় তখন সে হীনমন্যতায় ভোগে। আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা বা খেলাধুলাও বন্ধ করে দেয়। ফলে সে মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়।

এবার আসি তরুণদের কথায়, বর্তমানে আমাদের তরুণসমাজ এতটা ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে পড়েছে যে তারা হাটে, ঘাটে, রাস্তায় এমনকি ক্লাসরুমেও মোবাইলফোন ব্যাবহার করছে। ১০ মিনিটের জন্যও মোবাইলফোন থেকে আড়াল হলেই যেন তারা অশান্তিতে ভোগে। আর আমাদের শিক্ষার্থীরা এতটাই মোবাইলভিত্তিক শিক্ষাব্যাবস্থার উপর নির্ভর হয়ে গেছে যে, আগে যেখানে শিক্ষার্থীরা একটি শব্দার্থ জানার জন্য অভিধানের বই খুঁজত, সেখানে তারা একটি শব্দার্থ জানার জন্যও মোবাইলফোনের সহায়তা নিয়ে থাকে। তাদের কেনাকাটা, পড়াশোনা, ভ্রমণ, খেলাধুলা, আড্ডা, বিনোদন সবই এখন ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন অনলাইনভিত্তিক ক্লাসের প্রকোপে তরুণসমাজে স্মার্টফোন আসক্তি আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাস বা এসাইনমেন্টের সুবিধার্থে অভিভাবকরা সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দেয়; আর সন্তানরা সেটাকে অযাচিত ব্যবহার করে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, রিলস, গেইমস ইত্যাদিতে মগ্ন থেকে নির্ঘুম রাত পার করছে আজকের তরুণরা। ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটছে। মাথাব্যথা, ক্ষীণদৃষ্টি, ঘাড়ব্যথা, হতাশা, মেজাজ খিটখিটেসহ নানান সমস্যা তরুণ সমাজে দেখা দিচ্ছে।

মোবাইলফোন আসক্তি শুধু শিশু আর তরুণসমাজেই নয়, আজকাল অভিভাবকদের মধ্যেও এ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আগে অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে আড্ডা উৎসব করে তাদের অবসর সময় কাটাত। কিন্তু এখন সময় পেলেই অভিভাবকরাও ডুবে থাকে ইন্টারনেটের অতল সাগরে। ফলে আগের তুলনায় এখন পারিবারিক বন্ধন, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি অনেকটাই কমে যাচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে মোবাইলফোন কিনে সেটাকে অপ্রয়োজনীয়ভাবেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

আবার মোবাইলফোনের এ অতিরিক্ত আসক্তির ফলে সমাজে উন্নতির পাশাপাশি নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ খুব সহজেই পর্নো সাইটে বিচরণ করছে। ফলে সমাজে ইভটিজিং, ধর্ষণ, ব্যাভিচারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আবার মোবাইলের মাধ্যমে অনেকে জুয়ায় আসক্ত হয়ে পরিবারে ও সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে। ইন্টারনেটে বিচরণের মাধ্যমে অনেকে আবার দিন দিন পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতিও অনুসরণ করছে। যা আমাদের দেশে অপসংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যাবহারকারীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। সামান্য অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্টের কারণে দাম্পত্যকলহ, প্রেমের প্রতারণাসহ খুন-খারাবিও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, নারী আসক্তির জন্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু সকল আসক্তির মূলে যে মোবাইলফোন আসক্তি সেটার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে দিনের পর দিন মোবাইল আসক্তির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজে নৈতিকতার আসন একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়াবে। সমাজে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। অল্প বয়স থেকেই শিশুরা প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে। আর ইন্টারনেটের উপর নির্ভর থেকে শিক্ষার্থীরাও মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। তাই মোবাইলফোনের অপব্যবহারের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে সরকারের জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেন ইন্টারনেট ব্যবহার না করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাচ্চাদের একটি নির্দিষ্ট বয়সে মোবাইলফোন ব্যাবহারের অনুমতি দিতে হবে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করার রীতি পাল্টিয়ে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিশু বয়স থেকেই বাচ্চাদের বই পড়া, পত্রিকা পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এরই মধ্যে মোবাইল আসক্ত সমাজের অনেক অবক্ষয় ঘটিয়ে ফেলেছে। তাই এ ভয়াবহ থাবার হাত থেকে বাঁচাতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত