প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
বিগত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) শুধু একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা না থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে, এবং এই বৈপ্লবিক প্রযুক্তির প্রভাব থেকে বাংলাদেশও বিচ্ছিন্ন নয়; বরং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’-এর রূপকল্প পূরণের প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে AI-এর অগ্রগতি ও ব্যবহার আমাদের জাতীয় এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে AI-এর বর্তমান ব্যবহার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, এর সম্ভাবনা ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। বর্তমানে AI-এর সবচেয়ে দৃশ্যমান ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশের ফিনটেক (Fintech) এবং টেলিকম খাতে। মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস (MFS) প্ল্যাটফর্মগুলো (যেমন: বিকাশ, নগদ) গ্রাহকের লেনদেন বিশ্লেষণ করে প্রতারণা শনাক্তকরণ (Fraud Detection), ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (Risk Management) এবং কাস্টমাইজড আর্থিক পণ্য সরবরাহের জন্য AI অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ক্রেডিট স্কোরিং এবং ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও ত্রুটিমুক্ত করতে AI-এর উপর নির্ভর করছে। একইভাবে, টেলিকম অপারেটররা কলড্রপ বিশ্লেষণ, নেটওয়ার্ক অপটিমাইজেশন এবং গ্রাহক পরিষেবার জন্য চ্যাটবট ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করে সেবার মান উন্নত করছে। স্বাস্থ্য খাতে AI-এর ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে টেলিমেডিসিন, রোগ নির্ণয়ে চিত্র বিশ্লেষণ (যেমন: এক্স-রে, এমআরআই), এবং ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো রোগের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে AI সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, যা সীমিত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপর চাপ কমাতে সহায়ক হবে।
এছাড়া, কৃষি খাতেও AI-এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে, যেমন- আবহাওয়ার তথ্য ও মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে ফসলের রোগবালাই শনাক্ত করা এবং সেচের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করা, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অপরিহার্য। অন্যদিকে, সরকারি পরিষেবাগুলোতে নাগরিকদের তথ্য যাচাইকরণ (যেমন: জাতীয় পরিচয়পত্র- (NID) এবং ই-গভর্ন্যান্স কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধিতে AI একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে AI-এর সম্ভাবনা বিশাল। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের জন্য অও ভিত্তিক সমাধান অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে এবং তার মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে AI-এর ডেটা বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে কাজে লাগানো সম্ভব। ম্যানুফ্যাকচারিং ও পোশাকশিল্পে (RMG) AI-এর রোবোটিক্স ও অটোমেশন প্রযুক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল, নির্ভুল ও সাশ্রয়ী করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। তবে, AI-এর এই অগ্রযাত্রা দেশের কাজের ক্ষেত্রে (Employment) এক দ্বিমুখী প্রভাব ফেলবে, যা নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
একদিকে, AI ও অটোমেশনের কারণে ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যাক-অফিস প্রক্রিয়া, ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস ও পোশাকশিল্পের পুনরাবৃত্তিমূলক ম্যানুয়াল কাজগুলো চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। গতানুগতিক ও রুটিন কাজগুলো মেশিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে শ্রমবাজারে একটি বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, যেখানে স্বল্প-দক্ষ শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে, AI নতুন ধরনের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে। AI ডেভেলপার, ডেটা সায়েন্টিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার, এআই এথিক্স অ্যাডভাইজার এবং এআই সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদদের চাহিদা বহুলাংশে বাড়বে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেশের শ্রমশক্তিকে বড় আকারের দক্ষতা উন্নয়ন (Upskilling) ও পুনর্বাসন (Reskilling) কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যক্রম সংশোধন করে কোডিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং AI-সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন, যাতে নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য তৈরি হতে পারে। এই বিপুল সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ, যার মধ্যে অন্যতম হলো পর্যাপ্ত ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব (বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে), AI বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞের ঘাটতি এবং নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিশাল ডেটা সেটের অভাব।
এছাড়াও, AI-এর নৈতিক দিক এবং ডেটা গোপনীয়তা (Data Privacy) ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করা অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা গেলে, AI শুধু একটি প্রযুক্তি হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে, যেখানে মানবসম্পদকে প্রযুক্তির সহযোগী হিসেবে প্রস্তুত করাই হবে মূল লক্ষ্য।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ