প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
মানুষের জীবন কখনও শান্ত, কখনও চ্যালেঞ্জে ভরা। আমরা প্রতিদিন নানা সংকটের মুখোমুখি হই- পরীক্ষা, অসুস্থতা, আর্থিক সমস্যা, পারিবারিক ঝগড়া বা মানসিক চাপ। এই সময় স্থির থাকা, সাহস ধরে রাখা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র শক্তি হলো আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা। ইসলামের শিক্ষা আমাদের স্মরণ করায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি সমস্যার সমাধান দেখান।
মুসলমানদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হলো : ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, নিমাল মাওলা ওয়া নিমান নাসির’ অর্থাৎ ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সেরা অভিভাবক এবং সেরা সাহায্যকারী।’
কোরআন স্মরণ করায় : ‘যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তাদের জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা আত-তালাক : ৩) এই আয়াত মানুষের অন্তরে স্থির বিশ্বাস জাগায়। বিপদ বা সংকটের সময় আল্লাহর ওপর আস্থা স্থাপন করলে মন শান্ত থাকে এবং মানুষের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করেন এবং বিপদের সময় সাহায্য প্রদান করেন।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা : নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রতিটি সংকটে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। তিনি সাহসী ও স্থির ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন আল্লাহই সেরা অভিভাবক। এক হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সহিহ তিরমিজি : ২১৯০)
মক্কা দখলের সময় নবী (সা.) ও সাহাবারা বিপদের সম্মুখীন হলেও নির্ভয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতেন। তাদের ধৈর্য, স্থিরতা এবং আস্থা সাহসের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আমাদের শেখায় যে, বিপদের সময় আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা আমাদের অন্তরে শান্তি এবং মনোবল দেয়। একবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাঈফ (মুখোশযুক্ত) শত্রুর হামলার মুখোমুখি হলেও সাহাবাদের সঙ্গে আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে প্রতিরোধ করেছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বিশ্বাস ও ধৈর্য বিপদ মোকাবিলায় কতোটা কার্যকর।
ইতিহাসের প্রেরণাদায়ক উদাহরণ : হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর পথে সন্তান ত্যাগের সময় নির্ভয়ে ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ যথেষ্ট এবং নিরাপদে রক্ষা করবেন। কোরআনে বলা হয়েছে- অবশ্যই আমার পালনকর্তা আমাকে যথেষ্ট (সূরা আস-সাফফাত : ১০৩)। একজন সাহাবা হযরত উমর (র.) তার জীবনের এক বিপদের সময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার উদাহরণ দেখিয়েছেন। শত্রুর হামলার মুখোমুখি হয়ে তিনি ধৈর্য এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আল্লাহর সাহায্য তার বিপদ নিরসনে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়।
দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর ওপর ভরসা : আমাদের জীবনে নানা সমস্যা, শিক্ষা, পরিবার, স্বাস্থ্য বা সামাজিক চ্যালেঞ্জ- প্রায়শই দেখা দেয়। এই সময় অন্তরে বলতে পারে- ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, নিমাল মাওলা ওয়া নিমান নাসির’। এটি মনে করিয়ে দেয় আল্লাহই সর্বদা সাহায্যকারী। এটি শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে না, অন্তরের শান্তি ও স্থিরতা আনতে সাহায্য করে। এক তরুণ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার মাধ্যমে মনকে স্থির করেছিলেন, অধ্যবসায় চালিয়ে যান এবং পরবর্তী পরীক্ষায় সফল হন। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর ওপর আস্থা আমাদের জীবনে নতুন শক্তি যোগায় এবং হতাশা দূর করে। এক পরিবার আয়তনে বড় আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সততা, পরিশ্রম ও ধৈর্য প্রদর্শন করে। কয়েক মাসের মধ্যে তাদের পরিস্থিতি উন্নতি হয়। এটি দেখায়, বিপদে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা জীবনে সমাধানের পথ খুলে দেয়। একজন চাকুরিজীবী কর্মী তার চাকরি হারিয়ে হতাশ হয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নতুন দক্ষতা অর্জন শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আরও ভালো অবস্থানে পৌঁছান। এটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখে, সে পুনরায় শক্তি অর্জন করতে পারে।
হাদিসে নির্দেশ : বিপদে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া এক ধরনের ইবাদত। এক হাদিসে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি বিপদের সময় আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন। (সুনান ইবনে মাজাহ : ৩৮৯১) হাদিসের নির্দেশ আমাদের শেখায়, যে কোনো বিপদে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া শুধুমাত্র প্রার্থনা নয়, এটি আত্মার শক্তি বাড়ানোর একটি উপায়। এটি আমাদের হতাশা দূর করে এবং অন্তরের শান্তি দেয়।
পরিশেষে, জীবনের প্রতিটি দুঃখ ও কষ্ট ধৈর্য, বিশ্বাস এবং আল্লাহর ওপর আস্থা দ্বারা সহ্য করা সম্ভব। ইসলামে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসই আত্মার শক্তি, যা বিপদের সময় সাহস ও স্থিরতা প্রদান করে। একজন মুসলমানের জীবনে আস্থা স্থাপন করা আল্লাহর ওপর সবচেয়ে বড় সহায়ক।
‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, নিমাল মাওলা ওয়া নিমান নাসির’ এই বাক্যই দৈনন্দিন জীবনকে শক্তিশালী করে, বিপদ ও চ্যালেঞ্জের সময় সাহস যোগায়। যারা হৃদয় থেকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ধারণ করে, তারা কখনও একা হয় না।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি