ঢাকা বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা

আরিফুল ইসলাম রাফি
কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা

কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা আজ আর কোনো ছোট সমস্যা নয়; এটি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির গভীরে গেঁথে যাওয়া এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট। এক সময় শিক্ষা ছিল জ্ঞান অর্জনের পথ, চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে তোলার মাধ্যম, মানুষ হওয়ার প্রস্তুতি। আর আজ সেই শিক্ষাই ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে, যেখানে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং সেন্টার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বইয়ের চেয়ে শীট’কে বেশি নির্ভরযোগ্য আর শেখার আনন্দের জায়গা দখল করেছে নম্বর ও রেজাল্টের আতঙ্ক।

কোচিংনির্ভরতা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে বছরের পর বছর ধরে জমে ওঠা এক ধরনের কাঠামোগত ব্যর্থতা। স্কুলে শিক্ষক আছেন, কিন্তু সময় নেই। পাঠ্যসূচি আছে, কিন্তু তা বাস্তবসম্মত নয়। ক্লাস আছে, কিন্তু শিক্ষার্থী সংখ্যার ভারে সেখানে ব্যক্তিগত মনোযোগ অসম্ভব। ফলে শিক্ষার্থী খুব দ্রুত বুঝে যায়, শুধু স্কুলের ওপর ভরসা করে পরীক্ষায় ভালো করা যাবে না। এই উপলব্ধি থেকেই শুরু হয় কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া, যা একসময় প্রয়োজন থেকে অভ্যাসে, আর অভ্যাস থেকে বাধ্যবাধকতায় রূপ নেয়।

আজ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে কোচিং ছাড়া পড়াশোনা কল্পনাই করা যায় না। অভিভাবকরা ভয় পান, কোচিংয়ে না দিলে সন্তান পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত থাকে, কোচিংয়ের কমন না পড়লে পরীক্ষায় ফেল করবে। শিক্ষকরা নিজেরাই কখনো কখনো ইঙ্গিত দেন, সব কিছু স্কুলে শেখানো সম্ভব নয়। এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা, এই অসহায়তাই কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার মূল জ্বালানি।

এই ব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এটি শিক্ষাকে ধনী ও গরিবের মাঝে নতুন করে বিভাজিত করছে। যার টাকা আছে, সে একাধিক কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, স্পেশাল ব্যাচে পড়তে পারে। আর যার নেই, সে শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়ে। মেধা এখানে আর একমাত্র মানদ- নয়; অর্থনৈতিক সামর্থ্য হয়ে ওঠে সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা যে সমতা তৈরির কথা ছিল, সেটিই হয়ে দাঁড়ায় বৈষম্য পুনরুৎপাদনের যন্ত্র।

কোচিংনির্ভরতা শিক্ষার্থীর মানসিক জগৎকেও ধ্বংস করে দেয়। সকাল থেকে স্কুল, স্কুলের পর কোচিং, রাতে প্রাইভেট পড়া; এই একঘেয়ে রুটিনে শিশু-কিশোরদের জীবনে আর কিছুই থাকে না।

খেলাধুলা, সৃজনশীলতা, বন্ধুত্ব, নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার সুযোগ; সব কিছু চাপা পড়ে যায় পরীক্ষার বোঝার নিচে। শিক্ষার্থী তখন মানুষ হয়ে উঠতে পারে না; সে কেবল একটি রেজাল্ট-উৎপাদনকারী যন্ত্রে পরিণত হয়। এই চাপ, এই দমবন্ধ করা প্রতিযোগিতা একসময় জন্ম দেয় চরম মানসিক ক্লান্তি, হতাশা এবং আত্মবিশ্বাসের ভাঙন।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই শিক্ষাব্যবস্থা শেখার আনন্দটাই কেড়ে নেয়। প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে যায়, ভুল করার ভয় চেপে বসে। শিক্ষকও অনেক সময় পরীক্ষার বাইরে কিছু শেখাতে আগ্রহী হন না, কারণ সেটি কাজের নয়। ফলে শিক্ষা হয়ে ওঠে জীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, কাগজের পাতায় বন্দি এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

কোচিং ব্যবসার বিস্তার শিক্ষকের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। একই শিক্ষক যখন স্কুলে সীমিত পড়ান আর কোচিংয়ে বিস্তারিত শেখান, তখন শিক্ষার্থীর কাছে স্কুলের ক্লাস গুরুত্ব হারায়।

শিক্ষা আর দায়িত্ব নয়, হয়ে ওঠে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ। এতে করে পুরো ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী শিখে যায় জ্ঞান নয়, কৌশলই আসল; বোঝা নয়, কমনই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যর্থতাও এখানে অস্বীকার করা যায় না। পাঠ্যসূচি তৈরি হয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে, পরীক্ষার প্রশ্ন হয় অতিমাত্রায় মুখস্থনির্ভর আর শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন হয় অপর্যাপ্ত। ফলে কোচিং একটি বিকল্প নয়, বরং ব্যবস্থার ভেতরের শূন্যতা পূরণের অবৈধ কিন্তু কার্যকর পথ হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র যখন শক্তিশালী, মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই শূন্যস্থান দখল করে নেয় বাজার।

সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো, আমরা ধীরে ধীরে এই অবস্থাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছি। কেউ আর প্রশ্ন করে না কেন স্কুলে পড়েও আলাদা করে পড়তে হয়, কেন শিক্ষা এত ব্যয়বহুল, কেন একটি পরীক্ষাই জীবনের সবকিছু নির্ধারণ করবে। এই নীরব সম্মতিই কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করছে।

এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কেবল কোচিং বন্ধের কথা বললেই হবে না। দরকার শিক্ষার উদ্দেশ্য নতুন করে ভাবা। শ্রেণিকক্ষকে হতে হবে শেখার প্রধান কেন্দ্র, পরীক্ষাকে হতে হবে মূল্যায়নের একটি অংশ, জীবনের একমাত্র মানদ- নয়। শিক্ষককে দিতে হবে সম্মান, প্রশিক্ষণ ও যথাযথ সুযোগ। শিক্ষার্থীকে দিতে হবে ভুল করার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার সাহস এবং মানুষ হয়ে ওঠার সময়।

কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা আসলে আমাদের সমাজের গভীর অনাস্থার প্রতিফলন; শিক্ষকের ওপর অনাস্থা, শ্রেণিকক্ষের ওপর অনাস্থা আর শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের ওপর অনাস্থা। যতদিন আমরা এই অনাস্থার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে মানবিক, সমতাভিত্তিক ও আনন্দময় করে তুলতে না পারব, ততদিন কোচিং থাকবে, চাপ বাড়বে, আর শিক্ষা তার আসল অর্থ হারাতে থাকবে। শিক্ষা তখন আর মুক্তির পথ হবে না; হয়ে উঠবে আরেকটি নিঃশব্দ বোঝা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে যাবে ক্লান্ত হৃদয়ে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ-

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত