ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শহুরে জীবনে একাকিত্বের বিস্তার

জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
শহুরে জীবনে একাকিত্বের বিস্তার

আধুনিক সভ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে শহরকে কেন্দ্র করে। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ- সব ক্ষেত্রেই শহর আজ মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল। অথচ এই ব্যস্ত, আলোকোজ্জ্বল, কোলাহলপূর্ণ শহরেই নীরবে বেড়ে চলেছে এক গভীর সামাজিক সংকট- একাকিত্ব। চারপাশে মানুষের ভিড় থাকা সত্ত্বেও শহুরে মানুষ আজ ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে। এই একাকিত্ব শুধু মানসিক কষ্ট নয়, বরং একটি ব্যাপক সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

শহুরে জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুতগতি ও প্রতিযোগিতা। মানুষ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ, যানজট, অফিস, পড়াশোনা ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এই ব্যস্ততার মাঝে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। গ্রামবাংলায় যেখানে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও সামাজিক মেলবন্ধন ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, শহরে সেখানে মানুষ অনেক সময় নিজের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তাও জানে না। সামাজিক যোগাযোগের এই সংকট শহরের মানুষকে মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ করে তুলছে।

শহরে বসবাসকারী মানুষের বড় একটি অংশই একক পরিবারে বসবাস করে। যৌথ পরিবারের ভাঙন শহুরে জীবনে একাকিত্বের অন্যতম কারণ। বাবা-মা কর্মজীবনে ব্যস্ত, সন্তানরা স্কুল ও কোচিংয়ে ব্যস্ত- ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিক কথোপকথনের সময় ক্রমেই কমে যাচ্ছে। একই ছাদের নিচে থেকেও অনেক সময় পরিবারগুলো মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, যা একাকিত্বকে আরও গভীর করছে।

প্রযুক্তির অগ্রগতিও শহুরে একাকিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চুয়াল জগৎ মানুষের জীবনকে সহজ করলেও বাস্তব সামাজিক সম্পর্ককে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানুষ এখন সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে স্ক্রিনে ডুবে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সামাজিকমাধ্যমে শত শত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও বাস্তব জীবনে অনেকেই অনুভব করে গভীর শূন্যতা। এই প্রযুক্তিনির্ভর জীবন শহরের মানুষের মধ্যে নিঃসঙ্গতা বাড়িয়ে তুলছে।

কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে একাকীত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। চাকরির চাপ, সময়ের অভাব ও কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতা মানুষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব তৈরি করছে। অফিস শেষে মানুষ ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে বাসায় ফেরে; কিন্তু কারও সঙ্গে মনের কথা বলার সুযোগ পায় না। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে কর্মসূত্রে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শহুরে একাকিত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ভালো শিক্ষা ও ভবিষ্যতের আশায় অনেক শিক্ষার্থী শহরে এসে হোস্টেল বা মেসে থাকে। পরিবার ও পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকার ফলে তারা মানসিক চাপ, হতাশা ও নিঃসঙ্গতায় ভোগে। পড়াশোনার চাপ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও সামাজিক সহায়তার অভাব তাদের একাকিত্বকে আরও তীব্র করে তোলে। বয়স্ক জনগোষ্ঠী শহুরে একাকিত্বের আরেকটি ভুক্তভোগী শ্রেণি। সন্তানদের কর্মব্যস্ত জীবন, আলাদা বসবাস কিংবা বিদেশে চলে যাওয়ার ফলে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা শহরে একা দিন কাটান। তাদের সঙ্গে কথা বলার বা সময় দেওয়ার মতো মানুষ প্রায়ই থাকে না। এই একাকিত্ব তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, যা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।

শহুরে একাকিত্বের প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এর সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি একাকিত্ব থেকে হতাশা, উদ্বেগ, অনিদ্রা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। মানসিক রোগের হার বৃদ্ধির পেছনেও একাকিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফলে এটি একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নিচ্ছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র- সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবারে সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সময় দেওয়ার প্রবণতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করে বাস্তব সামাজিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। পাড়া-মহল্লাভিত্তিক সামাজিক কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড শহরের মানুষকে একে অপরের কাছাকাছি আনতে পারে।

রাষ্ট্র ও নগর কর্তৃপক্ষেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শহর পরিকল্পনায় খেলার মাঠ, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার ও উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি করতে হবে, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করা এবং একাকিত্ব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোও জরুরি।

সবশেষে বলা যায়, শহুরে জীবনে একাকিত্ব একটি নীরব কিন্তু ভয়াবহ সংকট। আধুনিকতার সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের মানবিক সম্পর্ক ও সামাজিক বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। নইলে কংক্রিটের শহরে বসবাসকারী মানুষগুলো ক্রমেই মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়বে। শহর তখন শুধু উন্নয়নের প্রতীক নয়, একাকিত্বের নীরব কারাগারে পরিণত হবে।

জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত