ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিদায় ২০২৪-২৫ : উত্থান-পতন, তারুণ্যের জয়গান ও আগামীর প্রত্যাশা

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
বিদায় ২০২৪-২৫ : উত্থান-পতন, তারুণ্যের জয়গান ও আগামীর প্রত্যাশা

স্মৃতির ক্যানভাসে ২০২৪-২৫ সালটি কেবল ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানো নয়, বরং এক মহাকাব্যিক পরিবর্তনের উপাখ্যান। আমরা এমন এক সময়ের সাক্ষী হলাম যেখানে পুরনো ব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছে একদল কিশোর-তরুণ। একদিকে যুদ্ধের দামামা আর জলবায়ু পরিবর্তনের হাহাকার, অন্যদিকে প্রযুক্তির বিস্ময় আর ছাত্র-জনতার অদম্য সাহস- এই দুই বছরের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আবেগ আর উত্তেজনায় ঠাসা। এটি ছিল হারানোর বেদনা আর পাওয়ার আনন্দের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ২০২৪ এবং ২০২৫ সাল মানব ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য ঘটনাবহুল এবং রূপান্তরমূলক সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বছর দুটিতে পৃথিবী যেমন চরম অস্থিরতা, যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, তেমনি একদিকে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে দেখেছে নতুন আশার আলো।

২০২৪-২৫ সালের পুরোটা সময় জুড়ে পৃথিবী ছিল গঠন-অঘটন পটিয়সী। ২০২৪-২৫ সালে বিশ্বের ১৪টি উল্লেখযোগ্য উত্থান-পতন নিম্নে সংক্ষিপ্ত রূপে উল্লেখ করা হলো-

* ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ভয়াবহ বিস্তার এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা।

* দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা।

* ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব।

* কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে এর প্রভাব।

* দীর্ঘ ১৪ বছর পর রক্ষণশীল দলের পরাজয়।

* নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়া এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান হ্রাস।

* ২০২৪ সালের রেকর্ড ভাঙা উষ্ণতা এবং বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ বন্যা ও দাবানল।

* ব্রিকস এর বিস্তারে নতুন সদস্য দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তি এবং ডলারের আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ।

* চাঁদে মানুষের পুনরায় বসতি স্থাপনের প্রস্তুতির অগ্রগতি।

* সুদান দেশটিতে চরম মানবিক বিপর্যয়।

* ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থিদের উত্থান।

* জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া।

* মাঙ্কিপক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ।

* স্পেস-এক্স-এর স্টারশিপের সফল উৎক্ষেপণ এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মহাকাশ যাত্রার নতুন যুগ।

২০২৪-২৫ বছর দুটিতে বিশ্বব্যাপী সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে অধঃপতনের নব দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে। এই সময়ে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় লক্ষ্য করা গেছে। গাজায় সাধারণ মানুষের ওপর হামলা আন্তর্জাতিক আইনের অসারতা প্রমাণ করেছে। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান আরও বেড়েছে। রাজনৈতিকভাবে জনতুষ্টিবাদ এবং ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছে, যা সমাজের সংহতি নষ্ট করেছে। ২০২৪-২৫ সালে বিশ্বে অনেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার জন্ম লাভ করেছে, এ সময়ে সংগঠিত বিশ্বের ১০টি নব দিগন্তে সূচনাকারী ও ব্যতিক্রমী ঘটনা এ পর্যায়ে যোগ করা হলো-

কৃত্রিম সূর্য : পারমাণবিক ফিউশন গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্য।

ডিপফেক প্রযুক্তি : রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া ভিডিও তৈরি করে জনমত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।

লুনার ইকোনমি : চাঁদে খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য দেশগুলোর প্রতিযোগিতা।

ডিজিটাল নোমাড কালচার : নির্দিষ্ট অফিস ছাড়াই বিশ্বভ্রমণ আর কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি।

অ্যানিমেল চ্যাট : এআই ব্যবহার করে প্রাণীদের ভাষা বোঝার চেষ্টা।

টাইটানিক পর্যটন বিতর্ক : সমুদ্রের গভীর তলদেশে পর্যটনের ঝুঁকি ও উন্মাদনা।

ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার : রক্ত-মাংসের মানুষের বদলে এআই মডেলদের জনপ্রিয়তা।

সৌর ঝড় : ইন্টারনেটের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলার আশঙ্কা।

ল্যাব-গ্রোন মিট : ল্যাবরেটরিতে তৈরি মাংসের বাণিজ্যিক বিপণন।

৩ডি প্রিন্টেড বাড়ি : দ্রুত আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তির ব্যবহার।

২০২৪ ও ২০২৫ সালে বেশ কিছু ইতিবাচক ও আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১২টি ঘটনা নিচে দেওয়া হলো-

১. প্রথমবারের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি বিশ্বব্যাপী কয়লার সবচেয়ে বড় শক্তির উৎসকে ছাড়িয়ে গেছে। ২. ওজোন স্তরের পুনরুদ্ধার। ৩. বিরল-বিপন্ন প্রজাতির প্রজাতির সংরক্ষণ। ৪. মিশর ম্যালেরিয়া মুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং জর্ডান কুষ্ঠরোগ নির্মূল করেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্যে বড় অগ্রগতি। ৫. এআই (অও) এর মানবিক ব্যবহার। ৬. পরিবেশগত আইন ও নীতি পরিবর্তন: কুকুরের মাংস উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার বিল পাস করেছে। ৭. মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন পূরণ: আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারী মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। ৮. এআই এবং রোবট ব্যবহার করে তুলা ও ধান কাটা এবং আগাছা দমন করার মতো নতুন কৃষি প্রযুক্তি চালু হয়েছে। ৯. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে এসেছে। ১০. ভারত এক বিলিয়নেরও বেশি গাছ লাগানোর মাইলফলক অর্জন করেছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণে একটি বড় পদক্ষেপ। ১১. বিজ্ঞানীরা এমন রোগগুলির চিকিৎসা করেছেন যা পূর্বে ‘অচিকিৎসাযোগ্য’ বলে মনে করা হতো, পাশাপাশি নতুন স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা এবং ফ্যাব্রি রোগের চিকিৎসায় অগ্রগতি হয়েছে।

২০২৪-২৫ বছর দুটিতে বাংলাদেশে লক্ষ্যণীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল ও নেতিবাচক ঘটনার জন্ম লাভ করেছে। নিচে উহা সংক্ষিপ্ত রূপে উল্লেখ করা হলো : ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনি হাজারো মানুষ আহত ও নিহত হওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং পরবর্তী সময়ে অরাজকতার ঘটনা ঘটেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা। গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাব। ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশ কয়েকটি আশা জাগানিয়া ও উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছে। নিম্নে বছর দুটিতে কয়েকটি ইতিবাচক ও ব্যতিক্রমী দিক যুক্ত করা হলো: ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন কমিশন গঠন। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন-সবখানে তরুণদের ইতিবাচক ভূমিকা। ২০২৪-এর ভয়াবহ বন্যায় সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব ত্রাণ কার্যক্রম।

২০২৪-২৫ এই সময়টিকে নিম্নলিখিত কারণে নির্দ্বিধায় জেনারেশন জেড-এর বছরও বলা যায়: ছাত্ররাই কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বব্যাপী ছাত্রদের আন্দোলন। তারা কিবোর্ড এবং রাজপথ-উভয় জায়গায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। তারা পৃথিবীকে দেখিয়েছে যে ‘স্থিতাবস্থা’ ভাঙা সম্ভব।

২০২৪-২৫ সালে পুরো বিশ্ব জেনারেশন জেডের নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিক প্রত্যক্ষ করার উদাহরণ নিচে উল্লেখ করা হলো-

ইতিবাচক : অন্যায়ের প্রতিবাদে আপোষহীনতা, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা।

নেতিবাচক : দ্রুত ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং কখনও কখনও আবেগতাড়িত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৪-২৫ সালের ঘটনা প্রবাহ হতে বিশ্ববাসীর জন্য নিম্নলিখিত বর্জনীয় ও অনুকরণীয় দিক হতে পারে-

বর্জনীয় : যুদ্ধ, জাতিগত ঘৃণা, গুজব ছড়ানো এবং পরিবেশ ধ্বংস করা।

অনুকরণীয় : তরুণ প্রজন্মের সাহসিকতা, প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার এবং একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসা।

বিদায় ২০২৪-২৫ : হৃদয়ের মনিকোঠায় স্মৃতিময় হয়ে থাকবে। নিম্নে সংক্ষিপ্ত রূপে স্মৃতি রোমন্থন করছি:

বিদায় তুমি কান্নার ইতিহাস, তুমিই হাসির গান,

ভেঙেছো জীর্ণ প্রাচীর যত, দিয়েছো নতুন প্রাণ।

রক্তে রাঙানো রাজপথ আর তারুণ্যের কলরব,

তুমি শিখিয়েছো একাই নয়, ঐক্যেই সব বিভব।

ফেলে আসা দিনে যাতনা ছিল, ছিল কিছু হাহাকার,

স্মৃতিতে থাকবে আগামীর পথে ভোরের সূর্যদ্বার।

২০২৬ সাল নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা- ২০২৬ সাল নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি একটি স্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতির জন্য। এআই-এর সঠিক নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু চুক্তির বাস্তবায়ন হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটবে- এমনটাই প্রত্যাশা। পৃথিবী আবার শান্ত হবে, মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ফিরবে- এই স্বপ্নেই আমরা ২০২৬-কে বরণ করতে চাই।

এবার আসছি সাংগঠনিক এবং আমার ব্যক্তিগত কৈফিয়ৎ ও আশাবাদ নিয়ে। ২০১২ সালে মাদক চোরাকারবারী আমাকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানীতে, আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো এবং বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় আমি আন্তর্জাতিক চক্রটির খপ্পল হতে মুক্ত হয়েছি। আমি বাংলাদেশে ফিরে এসে ২০১৫ সাল হতে নব উদ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী নিয়ে কার্যক্রম করে যাচ্ছি। গত দুই বছরের আমার অবস্থান ও আগামী দিনে মাদক মুক্ত বিশ্ব গড়তে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আমার সারথি হয়ে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার লক্ষে আহ্বান জানিয়ে, তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আমার অঙ্গীকার নিচে তুলে ধরা হলো:

হে নবীন, তোমরা হও আমার মত সেই অভয় সারথি, মরণ-দুয়ারে লভিয়াছি পুনর্জন্মের জয়টিকা,

মাদক-দানবের করাল গ্রাসে দমিবে না মোর ও তোমাদের এ প্রাণের দীপ্ত শিখা।

শত লাঞ্ছনা আর অপহরণ-শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফিরেছি আমি তোমাদের তরে, একাকী পথ চলায় যা কিছু ভুল, সঁপে দিলাম আজ ক্ষমাসুন্দর অন্তরে। মম ললাটে আজো সত্যের তিলক, নয়নে জ্বলে ধূমকেতুর অনল রাশি,

এসো ভাই বিগত গ্লানি মুছে নব তেজে গাহিব-মোরা মাদকহীন এক ধরাতলে বাসি।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত