প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫
গত ৩০ ডিসেম্বর ভোর ৬টায় মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি নামে খ্যাত বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর দিয়ে সকাল শুরু হয়। শীতের কুয়াশার মতোই পুরো দেশে গভীর শোক নেমে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা শুধু ক্ষমতার আসনে বসেছিলেন এমনটি নয়, বরং তাদের জীবন ও ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক রাজনৈতিক চরিত্র। তার রাজনৈতিক জীবন ছিল উত্থান-পতন, সংঘাত ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক দীর্ঘ অধ্যায়, যা বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ কোনো পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রস্তুতির ফল ছিল না। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এক অনিবার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসেন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানো তার এই যাত্রা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া নিজেকে শুধু একজন দলনেত্রী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং ক্ষমতার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হন। সামরিক শাসন-উত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি দ্রুতই জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তার ভূমিকা তাকে বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত করে। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বেগম খালেদা জিয়া ২০ মার্চ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন । এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে এটি ছিল এক নতুন দিগন্তের সূচনা, যদিও বাস্তব রাজনীতির কঠোরতা তাকে কখনোই ছাড় দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনামল ছিল নানা মাত্রায় আলোচিত। একদিকে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের কাঠামো বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধ ও আস্থাহীনতার পরিবেশও গভীর হয়েছে। প্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রেই তার সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা ও সমালোচনা পাশাপাশি চলেছে। এই দ্বৈততা তার পুরো রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী দিক হলো শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্ব শুধু দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুই বিপরীত মেরুতে ভাগ করে দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে দুই নেত্রীর রাজনীতি দেশকে বিভক্ত রেখেছে, যার প্রভাব পড়েছে সংসদ, রাজপথ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। বিরোধী দলে থাকাকালীন খালেদা জিয়া রাজপথকেন্দ্রিক আন্দোলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। সংসদের বাইরে আন্দোলনকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা তার নেতৃত্বে আরও দৃশ্যমান হয়। নির্বাচন বর্জন, কর্মসূচি ও আন্দোলনের রাজনীতি তার দলের প্রধান অস্ত্র ছিল। সমর্থকদের কাছে এটি ছিল আপসহীন অবস্থানের প্রতীক, আবার সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি রাজনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টির কারণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক ভূমিকা সংকুচিত হতে থাকে।
শারীরিক অসুস্থতা, আইনি মামলা জটিলতা এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা তাকে সক্রিয় নেতৃত্ব থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে দেয়। একসময় যিনি ছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে, তিনি পরিণত হন অপেক্ষাকৃত নীরব এক উপস্থিতিতে যার প্রভাব আছে, কিন্তু সক্রিয় অংশগ্রহণ সীমিত। তবে এই নীরবতাও ছিল রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ খালেদা জিয়া শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি রাজনৈতিক পরিচয় ও ধারার প্রতীক। তার অনুপস্থিতিতেও দলীয় রাজনীতিতে তার নাম, অবস্থান ও সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আলোচনা চলেছে। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে, তিনি রাজনীতির বাইরে থেকেও রাজনীতির অংশ ছিলেন।
ইতিহাসের বিচারে বেগম খালেদা জিয়াকে একমাত্রিকভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন। তিনি যেমন ছিলেন গণতান্ত্রিক ধারার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি, তেমনি ছিলেন সংঘাতমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশও। তার শাসনামল ও বিরোধী রাজনীতি দুটিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে। নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে নারী নেতৃত্ব এখনও নানা বাধার মুখে পড়ে, সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে তার অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাজনীতির কঠিন বাস্তবতার এক বাস্তব পাঠ।
আজ বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসের পাতায়। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরে এসে তিনি এখন মূল্যায়নের জায়গায় যেখানে সময়ই শেষ বিচারক। আবেগ নয়, বরং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণেই তার ভূমিকার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হবে।
এক সময়ের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ইতিহাসের পাতায় পৌঁছানো বেগম খালেদা জিয়ার যাত্রা বাংলাদেশের রাজনীতিরই এক প্রতিচ্ছবি। তার জীবন ও রাজনীতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।
ব্যক্তি চলে যান, থেকে যায় তার রেখে যাওয়া অধ্যায়, আর সেই অধ্যায়ই ভবিষ্যৎ রাজনীতির পাঠ হয়ে ওঠে। শেষ হয়েও হয় না শেষ তিনি আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যানে তার রেখে যাওয়া স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষকে পথ দেখাবে। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের প্রতিটি প্রাণে।
মোহাম্মাদ আশিক
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়