ঢাকা বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জাতীয় অভিভাবকের মহাপ্রস্থান

শাহেদ শফিক
জাতীয় অভিভাবকের মহাপ্রস্থান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া একটি অবিস্মরণীয় নাম। তার রাজনৈতিক জীবন শুধু একটি দলের নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নারী নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় সংকটকালে আপসহীন প্রতিরোধের এক জীবন্ত প্রতীক। যখন দেশের গণতন্ত্র, বিচারিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তখন তার অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা জাতির জন্য এক অভিভাবকত্বের ভূমিকা পালন করেছে। সেই অভিভাবকের বিদায়ে আজ দেশ দিশাহারা। বেগম জিয়ার এই মহাপ্রস্থানে দেশ হারিয়েছে তার অন্যতম অভিজ্ঞ অভিভাবক। এই প্রস্থান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নয়; এটি একটি সময়, একটি রাজনৈতিক ভারসাম্য ও একটি অভিভাবকসুলভ উপস্থিতির অবসান। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, সাহস ও ধৈর্যের প্রতীক হিসেবে যিনি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার চলে যাওয়া জাতিকে এক গভীর শূন্যতার মুখোমুখি করেছে। এরমাধ্যমে গভীর শোক, শূন্যতা ও অনিশ্চয়তার এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন ছিল ঘটনাচক্রে, কিন্তু তার উত্থান ছিল ইতিহাসগড়া। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যখন বিএনপি নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে, তখন একজন গৃহিণী হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়াকে রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় নামতে হয়। শুরু থেকেই তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সন্দেহ ও অবমূল্যায়ন। তবুও ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি প্রমাণ করেন, নেতৃত্বের জন্য শুধু দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাই নয়, প্রয়োজন সাহস, প্রজ্ঞা, নৈতিক দৃঢ়তা ও জনগণের সঙ্গে গভীর সংযোগ।

১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তিনি হয়ে ওঠেন আপসহীন কণ্ঠস্বর, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার সাহস পায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল তার অন্যতম দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, যার মাধ্যমে দেশ সামরিক শাসনের দীর্ঘ ছায়া থেকে বেরিয়ে একটি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রত্যাবর্তন করে।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনামলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, গ্রামীণ বিদ্যুৎায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে তার সরকারের উদ্যোগ সাধারণ মানুষের জীবনে বাস্তব প্রভাব ফেলেছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন, টেলিযোগাযোগ খাতের প্রসার এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করার দিকে মনোযোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি ৯/১১ পরবর্তী বিশ্ব বাস্তবতায় সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন যেমন, বিরোধী দলেও তার ভূমিকা ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলে থেকে তিনি নির্বাচন ব্যবস্থার সংকট নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করেন, যার ফলশ্রুতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়, যা বহু বছর ধরে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ভিত্তি তৈরি করে। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যেও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার এই মানসিকতা তার নেতৃত্বকে অনন্য করেছে। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়। গ্রেপ্তার, কারাবাস, একের পর এক মামলা এবং দীর্ঘ চিকিৎসা সংকট, সবকিছু সত্ত্বেও তিনি আপস করেননি। কারাগারে থেকেও তিনি সহিংসতার পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পরও তিনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, বারবার সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলেছেন। সংঘর্ষ নয়, রাজনৈতিক সমাধান, এই দর্শনই তাকে আলাদা করেছে। দীর্ঘ এক দশক ধরে মামলা, গৃহবন্দিত্ব ও অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও খালেদা জিয়া ছিলেন বিএনপি ও বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় আস্থা। তাকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি একটি আদর্শ, একটি চেতনা ও একটি আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশপ্রণোদিত বলে সমর্থকদের বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসই তাকে ঘিরে সহানুভূতি ও ঐক্যের শক্তভিত্তি গড়ে তোলে।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়, যখন গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত, বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন খালেদা জিয়ার মতো অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব জাতির জন্য ছিল এক আশ্রয়স্থল। জাতীয় ঐক্য সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন বা সাংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ আস্থা রাখতে পারত। তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও সংযত ভাষা তাকে প্রকৃত অর্থেই জাতীয় অভিভাবকের মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছিল।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার মানবিক সংবেদনশীলতা। রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি কখনও প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিতে বিশ্বাস করেননি। ক্ষমতায় থাকাকালীন যেমন, তেমনি বিরোধী দলে থেকেও তিনি বারবার রাজনৈতিক সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে কেবল দলীয় নেত্রী নয়, বরং রাষ্ট্রনায়কসুলভ উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। দেশের সংকটকালে তার এই সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানই বহু নাগরিকের কাছে তাকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবে বিবেচিত করেছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমে অবিচল। জীবনের কঠিন সময়ে বহু নেতা যখন দেশ ছেড়ে গেছেন, তিনি তখন বলেছিলেন, এই দেশই তার একমাত্র ঠিকানা। সেই অবস্থান তার রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রতিফলন। আজ তার দেহাবসানে সেই নৈতিকতার এক জীবন্ত অধ্যায় শেষ হলো, কিন্তু তার আদর্শ, সংগ্রাম ও শিক্ষা রয়ে গেল জাতির স্মৃতিতে। খালেদা জিয়ার জীবন শুধু একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক উত্থান-পতনের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস। নারী নেতৃত্বের পথকে যিনি সাহসিকতার সঙ্গে উন্মুক্ত করেছেন, যিনি ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে থেকেও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন থেকেছেন, তার এই মহাপ্রস্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র শুধু প্রতিষ্ঠান দিয়ে চলে না, চলে অভিজ্ঞতা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের সমন্বয়ে।

শাহেদ শফিক

সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত