ঢাকা বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

একটি যুগের অবসান ও গণতন্ত্রের এক আপসহীন কণ্ঠস্বরের বিদায়

একটি যুগের অবসান ও গণতন্ত্রের এক আপসহীন কণ্ঠস্বরের বিদায়

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের অন্যতম ধ্রুবতারা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। তার এই চিরবিদায় শুধু একটি রাজনৈতিক দলের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গত চার দশকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল নাটকীয়তা, ত্যাগ এবং অদম্য সাহসিকতায় ঘেরা। ১৯৮১ সালে এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হারানোর পর, এক সাধারণ গৃহবধূ থেকে দেশনেত্রী হয়ে ওঠার গল্পটি ছিল অত্যন্ত বন্ধুর। বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে দলের হাল ধরে তিনি যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল। ১৯৯১ সালে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনামলে নারী শিক্ষার প্রসার, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিল। তবে খালেদা জিয়ার রাজনীতির মূল সুর ছিল ‘আপসহীনতা’। আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছরের রাজপথের লড়াই তাকে ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ক্ষমতা বা ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি বরাবরই অটল ছিলেন। বিশেষ করে গত দেড় দশকে তার ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসা কারাবরণ, গৃহবন্দিত্ব এবং অসুস্থতার চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তার রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। চরম শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার যে দৃঢ় ইচ্ছা তিনি পোষণ করেছিলেন, তা তার দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এমন এক সময়ে তার প্রস্থান রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করল। খালেদা জিয়া শুধু একটি দলের প্রধান ছিলেন না, তিনি ছিলেন কোটি কোটি মানুষের আশার প্রতীক। তার রাজনীতি ছিল জনমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই। প্রতিহিংসা ও বিভাজনের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার অভাব বারবার অনুভূত হবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত ও পথের ভিন্নতা থাকবেই, কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন জাতীয় নেত্রীর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি ইতিহাসের এমন এক স্তরে অবস্থান করছেন, যেখানে তার সমালোচনা বা প্রশংসা উভয়ই হবে দীর্ঘস্থায়ী। তবে ইতিহাসের পাতায় তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে, যিনি প্রতিকূল স্রোতে কখনও মাথানত করেননি।

আমরা মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার ও দেশজুড়ে অগণিত ভক্ত-অনুরাগীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে, তা কাটিয়ে উঠতে ধৈর্য ও সংহতির প্রয়োজন। তার রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশপ্রেম আগামী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত