
কোক স্টুডিও বাংলার সিজন-৩ এর শেষ গান ‘মাস্ত কালান্দার’-এ মাতোয়ারা সারা দেশ। রুনা লায়লার এ গানটি যেন তার ভক্তদের জন্য এক দারুণ উপহার। প্রায় ৮ শতাব্দী প্রাচীন এই সুফিবাদী গানটির অজস্র সংস্করণ তৈরি হয়েছে। কয়েক শতাব্দী ধরে আলাদা আলাদা লিরিকে ও ভঙ্গিতে মানুষ এটি গেয়ে আসছে।
কাওয়ালি ঘরানার গানটি ভারতের পাঞ্জাব, পাকিস্তানের সিন্ধ আর ইরানেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। পাকিস্তানের সিন্ধের সুফিসাধক সৈয়দ উসমান মারভান্দির (১১৭৭-১২৭৪) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গানটি গাওয়া হয়েছে। সব ধর্ম ও শ্রেণির লোকের কাছেই জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় গুরু ছিলেন সৈয়দ উসমান মারভান্দি। ভক্তরাই তার নাম দেন ‘লাল শাহবাজ কালান্দার’, যার প্রতিটি অংশের আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে। তিনি লাল বা গেরুয়া রঙের পোশাক পরতেন। আবার প্রিয়জন বোঝাতেও ব্যবহার করা হয় ‘লাল’ শব্দ। সুফিবাদে লাল রং ভক্তি, প্রেম ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক।
‘দমাদম মস্ত কালান্দার’-এর মূল অংশ ও ভাবের রচয়িতা বলা হয় ফার্সি ও উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি, গায়ক ও সুফি সাধক আমির খসরুকে। তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ঘনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। তাকে কাওয়ালির জনক বলা হয় অর্থাৎ কাওয়ালি ঘরানা শুরু হয়েছে তার হাত ধরে। এরপর আমির খসরুর লেখায় পাঞ্জাবের বিখ্যাত সুফি কবি ও দার্শনিক বুল্লেহ শাহ কিছু লাইন যুক্ত করেন। তিনি মূলত পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সেহওয়ানের বিখ্যাত সুফি সাধক লাল শাহবাজ কালান্দরকে নিয়ে স্তুতিমূলক কথা মূল গানের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এসব সংযোজনের ফলে গানটি পুরোপুরি কাওয়ালি হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই শাহবাজ কালান্দারের দরগাহে এই গান গাওয়া হতো। ১৯৫৬ সালে কিছু কথা বদল করে পাকিস্তানি ছবি ‘জাবরু’র জন্য গানটির একটি ‘ধামাল’ (এক ধরনের সুফি নৃত্যানুষ্ঠান) সংস্করণ তৈরি করেন সুরকার আশিক হুসাইন। এটিতে কণ্ঠ দেন ইনায়েত হোসেন ভাট্টি, ফজল হুসেন এবং এ আর বিসমিল। কাওয়ালি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে এই গান গাওয়া হলেও নুর জাহান, আশা ভোসলে, রুনা লায়লায় মতো উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পীরা এটিকে তাদের মতো করে স্টেজে গেয়েছেন। তবে সবার সংস্করণে কথার কিছু পার্থক্য আছে, রুনা লায়লার ভার্সন, নুসরাতের ভার্সন বা আবিদা পারভীনের ভার্সনে লাইনগুলো সব এক নয়। তবে সবখানেই মূলভাব একই, লাল শাহবাজ কালান্দরের স্তুতি।
১৯৬৯ সালে উর্দু সিনেমা ‘ডিলান দে সৌদে’-তে নুর জাহানের গলায় গানটি প্রকাশের পর থেকেই মূলত সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। বলা যায় সেটিই এই গানের প্রথম জনপ্রিয় সংস্করণ। এরপর এটি গেয়েছিলেন রুনা লায়লা। তবে রুনা লায়লার গলায় গানটি একাধিকবার রেকর্ড হয়েছে। প্রথমবার রেকর্ড হয় ১৯৮৩ সালে পাকিস্তান থেকে, অ্যালবামের নাম ‘নন-স্টপ ধামাল-রুনা সিংস শাহবাজ কালান্দার। প্রকাশিত সেই সিঙ্গেলের কাভারে দেখা যায়, মূল লিরিকের সঙ্গে সেখানেও কিছু লাইন যুক্ত করে লিরিক পরিমার্জন করেছিলেন পুরণম।
এরপর ১৯৮৪ সালে ভারতের কনকর্ড রেকর্ড থেকে বের হয় রুনা লায়লার এলপি ‘দ্য লাভস অফ রুনা লায়লা। এখানেও গানটি ছিল মূলত আগের বছরের ভার্সনের সঙ্গে মিল রেখে। পরে ভারতের ও পাকিস্তানের আরও কয়েকটি রেকর্ড লেবেল থেকে রুনা লায়লার গলায় এই গান প্রকাশ পায়। যদিও দশকের পর দশক ধরে অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পী ‘মাস্ত কালান্দার’ পরিবেশন করেছেন, তবু রুনা লায়লার কণ্ঠই এই গানকে সত্যিকারের সাংস্কৃতিক বিস্ময়ে রূপ দেয় সীমান্ত পেরিয়ে দূর দেশেও পৌঁছে দেয় এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করে এক অনন্য বাংলাদেশি কিংবদন্তি হিসেবে। তার গাওয়া সংস্করণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফিরে আসে; সেই কণ্ঠেই গানটি শ্বাস নেয়, বেঁচে থাকে, বহমান থাকে।