মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় শিশুটির চিকিৎসা ও সুষ্ঠু বিচারের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ ঘটনার কয়েকদিন অতিবাহিত হলেও এখনো ঘঠনাটি নিয়ে সারাদেশ উত্তাল। এ কারণে সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে গুজব না ছড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আব্দুল কালাম আজাদ মজুমদার জানিয়েছেন, মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটি চোখের পাতা নেড়েছে। তার অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
আব্দুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ শিশুটির বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আজও তিনি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটির শারীরিক অবস্থার খুব সামান্য উন্নতি হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো শিশুটি চোখের পাতা নেড়েছে। তবে শ্বাসরোধের কারণে তার মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছিল। মস্তিষ্কে পানি জমে গিয়েছিল, যেটা অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। তার বুকের মধ্যে যে বাতাস জমে ছিল সেটি দূর করা গেছে। চিকিৎসকরা আশাবাদী দুই একদিনের মধ্যে শিশুটির অবস্থার আরও উন্নতি হবে।
জানা যায়, মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির চিকিৎসা চলছে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) প্যাডিয়াট্রিক আইসিইউতে। গত রোববার দিবাগত রাত ১টার দিকে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে এ তথ্য জানানো হয়। গত রোববার গভীর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শিশুটির শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন পোস্টে বলা হয়, শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় শিশুটির লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়েছে। শিশুটিকে এখন পিআইসিইউতে রাখা হয়েছে। তবে এ তথ্যের সত্যতা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসক ও শিশুটির স্বজন।
মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, শিশুটির লাইফ সাপোর্ট একবারের জন্যও খোলা হয়নি। শিশুটি এখনো সংকটাপন্ন। তার অবস্থা অপরিবর্তিত। সে বেঁচে থাকার লড়াই করছে।
শিশুটির মামাতো ভাই বলেন, চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত। লাইফ সাপোর্টেই আছে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের এই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন শিশুটির মা। শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর-শাশুড়ি ও ভাশুরকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। শিশুর বোনের শ্বশুরকে সাত দিন, স্বামী, শাশুড়ি ও ভাশুর প্রত্যেকের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মাগুরার আদালত। গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। ওই দিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিআইসিইউ থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সিএমএইচের প্রধান সার্জনকে প্রধান করে আটজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডে রয়েছেন সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, প্লাস্টিক সার্জন, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু হৃদরোগ বিভাগ, শিশু বিভাগের সার্জন, ইউরোলজি বিভাগ, থোরাসিক সার্জন বিভাগের চিকিৎসকেরা।
এদিকে মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় নিরাপত্তা শঙ্কায় গভীর রাতে আসামিদের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করেছেন আদালত। গত সোমবার মধ্যরাত ১২টার পর শুরু হয় এই রিমান্ড শুনানি।
রিমান্ড শুনানি শেষে মামলায় মূল আসামি শিশুটির বোনের শ্বশুর হিতু মিয়াকে (৪২) সাত দিন এবং শিশুটির দুলাভাই সজীব হোসেন (১৮), সজীবের ভাই রাতুল শেখ (১৭) ও মা জাবেদা বেগমকে (৪০) পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করে। মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মতিন এ আদেশ দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের প্রত্যেককে সাত দিন করে রিমান্ডে দেওয়ার আবেদন করেন। এই মামলায় আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি। তবে, আদালত তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন এবং তাদেরকে রিমান্ড না দেওয়ারও দাবি জানান।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ঢাকায় সিএমএইচে ভুক্তভোগী শিশুটি অচেতন থাকায় তার জবানবন্দি নেয়া যায়নি। ফলে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন বলেন, নিরাপত্তার কারণে রোববার দিনে আসামিদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। তাই অনেক রাতে নিয়ে যেতে হয়েছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তিনি জানান, রোববার সকাল থেকে সারাদিন মাগুরা শহরে শিশু ধর্ষণে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দাবিসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মূল গেট অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। সন্ধ্যার পর শহরে আবার মশাল মিছিল করেন তারা।
মো. আলাউদ্দিন বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসামিদের রাতে আদালতে নিতে হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) চিকিৎসাধীন শিশুটিকে গত রোববার লাইফ সাপোর্ট থেকে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার (পিআইসি) ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৭ মার্চ বিকেলে তাকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। চাঞ্চল্যকর শিশু ধর্ষণ মামলার আসামিপক্ষকে আইনি সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতি। বোনের বাড়িতে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে জেলা আইনজীবী সমিতি আয়োজিত মানববন্ধনে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সোমবার সকালে মাগুরা জেলা জজ আদালতের সামনে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহেদ হাসান টগর, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মুকুল, অ্যাডভোকেট রোকনুজ্জামান খান, অ্যাডভোকেট ফারহানা খানম বিউটিসহ আরও অনেকে।
এতে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, মাগুরার ন্যক্কারজনক ধর্ষণ মামলায় আসামি পক্ষকে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা না দিতে জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী সভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা নির্যাতনের শিকার শিশুটির পরিবারকে আশ্বস্ত করেছি যত দ্রুত মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকব। এছাড়া অভিযুক্তদের যেনো সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়া হয় সেই দাবি করছি।