ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ধর্ষকের শাস্তি জনসম্মুখে চান শিক্ষার্থীরা

* ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ঢাবির সাদা দলের * ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাজপথে নির্মাতারা * পুলিশের সঙ্গে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ
ধর্ষকের শাস্তি জনসম্মুখে চান শিক্ষার্থীরা

ধর্ষকের বিচারের দাবিতে কয়েকদিন ধরে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। এরমধ্যেই গতকাল রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের শাস্তি জনসম্মুখে করাসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছেন। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় আধাঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখা হয়। এতে যানবাহন চলাচলে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হলে পুলিশের অনুরোধে আন্দোলনকারীরা জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেন। এ দিন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের শিক্ষকরাও মানববন্ধন করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের মানববন্ধনে শিক্ষকরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, নারীর প্রতি অবমাননা বন্ধ এবং ধর্ষকদের বিচার করতে হবে। পলাতক শেখ হাসিনা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছেন। নিপীড়নের ঘটনাগুলোতে সাত দিনের মধ্যে শক্তভাবে অবস্থান নেয়ার দাবিও জানান তারা। মানববন্ধনে সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে যুগে যুগে। কখনওই আমরা এটি থেকে বের হতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে যখন হেনস্তা হতে হয় কর্মচারী দ্বারা এবং সেই হেনস্তাকেও কেউ কেউ আবার সমর্থন দেয়, তখন লজ্জায় আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। আমরা প্রশাসনকে বলব, এমন প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বলেন, শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

ধর্ষণ ও নারীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলোতে সাত দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিকে শক্তভাবে অবস্থান নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপি, আপনাদের সাত দিন সময় দিচ্ছি। এই সাত দিনের মধ্যে শক্তভাবে অবস্থান নিন। না হলে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসব। আমরা রাজপথে নেমে আসব। আমাদের এ প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।’

মাগুরায় শিশু ধর্ষণহ সারা দেশে নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। ২৪-এর বাংলাদেশে ধর্ষকের ঠাঁই নেই, আমার বোনের কান্না আর না আর না, সারা বাংলায় খবর দে ধর্ষকদের কবর দে, তুমি কে আমি কে আছিয়া আছিয়া, একটা একটা ধর্ষক ধর ধইরা ধইরা জবাই কর। ইন্টেরিম জবাব দে নইলে হাতে চুড়ি দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ একে একে রাজধানীর কমপক্ষে ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনে যোগ দেন। আস্তে আস্তে মিছিল ভারি হতে থাকে।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজের শিক্ষার্থী মো. নকীব সাদাত মাইকে শিক্ষার্থীদের নিবৃত করে বলেন, দেশে ধর্ষণের পরিমাণ অনেকটাই বেড়েছে। এ সরকারের কাছে আমাদের অনেক বড় প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আমরা দিন দিন আশাহত হচ্ছি। এ কারণে আমরা আজ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছি। সরকারের কাছে আমরা ছয়টি দাবি পেশ করছি। এগুলো অবিলম্বে মেনে নিতে হবে। আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে-১. ধর্ষকের শাস্তি জনসম্মুখে নিশ্চিত করতে হবে। যা সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ২. ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করতে হবে। ৩. যে কোনো ধর্ষণের ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষককে গ্রেপ্তার, মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করা এবং ভিকটিম ও সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে ধর্ষকের ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে। এতে কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে, সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। ধর্ষণ মামলার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে ধর্ষিত নারী এবং পুরুষের স্পার্ম পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। ৪. ধর্ষণের বিচার সালিশের মাধ্যমে করা যাবে না। এর বিচার নিশ্চিত করবে শুধুমাত্র রাষ্ট্র। সালিশি বিচার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। ৫. অপ্রাপ্ত বা বয়স্ক পুরুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে সর্বোচ্চ ফাঁসি এবং অন্তত আমৃত্যু কারাদণ্ড কার্যকর করতে হবে। ৬. চলমান সব ধর্ষণ মামলার বিচার আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়ে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি জাতীয় জাদুঘরের সামনে হওয়ার কথা। তবে তারা একপর্যায়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছিলেন। তখন জনদুর্ভোগ বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বললে বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রাজপথে নেমেছেন নির্মাতারা। নারী-শিশুর প্রতি চলমান সহিংসতা, নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এবার ছোটপর্দার নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড বাংলাদেশের সদস্যরা প্রতিবাদ জানালেন। সেই সঙ্গে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তারা।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন নির্মাতারা। এসময় উপস্থিত ছিলেন ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল হাসান, সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন রাশেদা আক্তার লাজুক, ফিরোজ খান, সকাল আহমেদ, চয়নিকা চৌধুরী, নিয়াজ মাহমুদ চন্দ্রদীপ, এনামুল কবির, লিপি আইস, প্রীতি দত্ত, পাংখা মনির, নাজমুল হুদা, জীবন রয়, রাজ্জাক রাজ প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, কয়েকদিন আগে মাত্র আট বছর বয়সি শিশু নৃশংসভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার ঘটনা প্রমাণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা নিরাপদ নয়। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নারী-শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান নির্মাতারা।

এদিকে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে অবস্থান নেয়া ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে রমনা জোনের এসিসহ সাত থেকে আট পুলিশ আহত হয়েছেন। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের তিনজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ নামে একটি প্লাটফর্ম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে যমুনা অভিমুখে রওনা হন আন্দোলনকারীরা। মিছিল থেকে তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দেন এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সব ধর্ষণকাণ্ডের বিচারের দাবি জানানো হয়। মিছিল নিয়ে শাহবাগ থেকে এগিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে আসতেই তাদের ঠেকিয়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু তারা পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মারধরের শিকার হন, তার জামা ছিঁড়ে যায়। এরপর পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে কিছুটা সরিয়ে দেয়। এতে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন আহত হন। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক সাজেদুল ইসলাম, শাকিল আহমেদ, ওহি, অং মারমাসহ কয়েকজন আহত হন। আন্দোলনরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অদ্রিতা রয় বলেন, যে মিছিলে সামনের সারিতে নারীরা ছিল সে মিছিলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পালিত পুলিশ হামলা চালিয়েছে। এ রমজান মাসে আমাদের নারীদের পোশাক ছেঁড়া হয়েছে। মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। লাঠিচার্জ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে থাকা রমনা জোনের ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘তারা পদযাত্রা করার কথা বলেছেন, আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তারা বাসভবনের দিকে ঢুকে যাওয়ায় আমরা বাধা দেই এবং বলি আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকলে পাঁচজন প্রতিনিধি পাঠান। এতে তাদের একটা পক্ষ রাজি হলেও আরেকটা পক্ষ ব্যারিকেড ভাঙতে শুরু করে, আমাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। আমরা কোনোভাবেই লাঠিচার্জ করিনি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এসি রমনাকে তারা ব্যাপক আকারে পিটিয়েছে, তার জামা ছিঁড়ে গেছে। আমাদের কিন্তু হাতে লাঠি ছিল না। আমরা টিয়ারশেল, সাউন্ডগ্রেনেড কিছুই ছুড়িনি। এ অবস্থায়ও তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি কিন্তু তারপরও আমাদের সাত-আটজন আজকে আহত হয়েছে। কয়েকজন বেশ গুরুতর আহত হয়েছে।’ মাসুদ বলেন, ‘তাদের সঙ্গে কথা ছিল- পাঁচজন প্রতিনিধি যাবে, আমরা তো বাধা দেইনি। কিন্তু এ জায়গাটা প্রটেকশনের আওতাধীন, এজন্য সবাইকে যেতে দেইনি। কিন্তু তারা শোনেনি। এরপরও আমরা ধৈর্য সহকারে ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের যেতে দেইনি এটা আমাদের অপরাধ। কিন্তু তাদের যেতে দিলে আমার আর চাকরি করার দরকার নেই।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত