বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জুলাই মাসে দেশজুড়ে উত্তাল অবস্থা ছিল। এই আন্দোলনে অন্যদের মতো মাঠে নেমে এসেছিল শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। সেই আন্দোলন দমাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি ও লাটি চার্জ করা হয়। তেমনি পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে একজনকে টেনে নিচে ফেলা হলো। তিনি সাঁজোয়া যানের চাকার কাছে সড়কে পড়ে থাকেন। এরপর পুলিশের এক সদস্য সাঁজোয়া যান থেকে নিচে নামেন। এক হাত ধরে তাকে টেনে আরেকটু দূরে সড়কে ফেলে রাখেন। এখানেই শেষ নয়, পরে কয়েকজন পুলিশ মিলে তাকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে ঠেলে অপর পাশে ফেলে দেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে ১৮ জুলাই ঘটনাটি ঘটে। যাকে ফেলে দেওয়া হয়, তার নাম শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। তিনি রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন, থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। বাসা সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়। তাকে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা ইয়ামিন নামেই ডাকতেন।
১৩ আগস্ট সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকার বাসায় বসে কথা হয় ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারও কাছে বিচার চাই না। জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি।’ ইয়ামিনকে এভাবে ফেলে দেওয়ার ভিডিও তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মহিউদ্দিন ভিডিওটি দেখেন ঘটনার দুই দিন পরে। মহিউদ্দিন বলেন, তার ছেলে ইয়ামিন মারা যাওয়ার পর তাকে নিয়ে ফেসবুকে একেকজন একেকভাবে মনগড়া কথা বলেছেন। তিনি চান, তার ছেলে সম্পর্কে সবাই সঠিক তথ্য জানুক।
ইয়ামিনের জন্ম ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এই দুই পরীক্ষাসহ বাংলাদেশ কেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াড-গণিত অলিম্পিয়াডে পাওয়া সনদ ও বিভিন্ন কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন ইয়ামিন। বাবা মহিউদ্দিন ছেলের একেকটা সনদ দেখাচ্ছিলেন আর স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলেন। ইয়ামিনের মা নাসরিন সুলতানা, তিনি গৃহিণী। বোন শাইখ আশহাবুল জান্নাত, তিনি পড়ছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা ও বোন ইয়ামিনকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইলেন না।
ইয়ামিনের বাবার অভিযোগ, তার ছেলে পুলিশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে কেউ রাজনৈতিক দলের দাবার ঘুঁটি বানাক, তা আমরা চাই না। আমার ছেলে রাজনীতিসচেতন ছিল। আমিও রাজনীতিসচেতন। তবে কোনো দল করি না। ছেলে বুয়েট ও রংপুর মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও পড়েনি। ছোটবেলায় পড়েছে সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। পরে ভর্তি হয় এমআইএসটিতে। এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই রাজনীতি করার সুযোগ নেই।’ মহিউদ্দিন বলেন, ‘তবে আমরা ধার্মিক পরিবার। ছেলে নামাজ পড়ত। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। এটা দেখে কেউ যদি আমার ছেলেকে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির বা জামায়াত বানানোর চেষ্টা করে, তা তো আমরা হতে দেব না।’
ছেলে ইয়ামিন তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মিরপুরে কোনো হাসপাতালের তার পরিচিত কেউ আছে কিনা তখন মহিউদ্দিন ছেলেকে বলেছিলেন, টেকনিক্যাল মোড়ের একটি হাসপাতালে আহত বন্ধুদের নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, এ কথা বলার পর ছেলে রাগ দেখান। সেটাই ছিল ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথা। ১৮ জুলাই আন্দোলনে উত্তাল ছিল সাভার এলাকা। মহিউদ্দিন বলেন, ‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘরে ফিরে ছেলেকে বলি, শুধু ঢাকা নয়, সাভারেও তো গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। ছেলে এ কথা শোনার পর কোনো কথা বলেনি। বুঝতে পারি, পরিচিত হাসপাতালের ঠিকানা দিতে পারিনি বলে ছেলে রাগ করেছে। তবে ছেলেকে দেখে বুঝতে পারি, সে তার বন্ধুদের নিয়ে চিন্তা করছিল।’
মহিউদ্দিন বলেন, ‘বাসায় টেলিভিশন নেই। তাই বাইরের কোনো খবর দেখতে পাচ্ছিলাম না। ইন্টারনেট কাজ করছিল না। তাই ফেসবুকেও কোনো খবর জানতে পারছিলাম না। অথচ ততক্ষণে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। বেলা ৩টার দিকে ইয়ামিনের মাকে একজন ফোন করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে যেতে বলেন। মহিউদ্দিন বলেন, ‘তখন মনে করেছি, ছেলে হয়তো আহত হয়েছে। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন পথ ঘুরে হাসপাতালে যাই। ছেলের নাম শুনে একজন বলেন, ওটিতে (অস্ত্রপচারকক্ষ) যান। সেখানে যাওয়ার পর আরেকজন নিচতলায় যেতে বলেন। এক নারী চিকিৎসক এসে ইয়ামিনের মাকে জড়িয়ে ধরেন। তখনো ছেলের মৃত্যুর কথা চিন্তা করিনি।’ মহিউদ্দিন জানান, ওই নারী চিকিৎসক তাদের একটি তালা দেওয়া রুমের সামনে নিয়ে যান। সেখানে শিক্ষার্থীদের অনেক জটলা ছিল। তালা খুললে দেখা গেল, একটি স্ট্রেচারে ইয়ামিন শুয়ে আছেন। তখন জানা গেল, এই হাসপাতালে আনার আগেই তার ছেলে মারা গেছেন। এখানে কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগই পাননি চিকিৎসকেরা। ছেলের বন্ধুরা জানান, ইয়ামিনকে প্রথমে বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ক্লিনিক ভর্তি করতে রাজি হয়নি।
মহিউদ্দিনের ভাষ্য, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগপর্যন্ত তার কাছে আওয়ামী লীগের নেতাসহ বিভিন্নজন ফোন করে ছেলের সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চান। কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে পুলিশ যায়। খোঁজখবর নেয়। মহিউদ্দিন গর্ব করে বলেন, তার ছেলে সাহসী ছিলেন। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। ক্লাসে এক শিক্ষককে ইয়ামিন সরাসরি বলেছিলেন, তার পড়ানো হচ্ছে না। দুই দিন পরে সেই শিক্ষক স্বীকার করেছিলেন, তিনি যেভাবে পড়াচ্ছিলেন, তা ঠিক ছিল না। ইয়ামিন মেধাবী ছিলেন বলে জানান তার বাবা। তিনি বলেন, বন্ধুরা কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে ইয়ামিন বুঝিয়ে দিতেন। ইয়ামিন বিতর্ক করতেন। এমআইএসটিতে বিতর্ক ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়ামিন।
সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায় ইয়ামিনকে কবর দেওয়া হয়েছে। তার কবরে একটি তুলসীগাছ ও একটি ফুলের চারা লাগিয়েছেন মা নাসরিন সুলতানা। মহিউদ্দিন একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, সন্তান মারা যাওয়ার মানে হলো আমৃত্যু কষ্ট। ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করার ভিডিও দেখাটা আরও কষ্টের।
বন্ধুর স্মৃতিচারণ: শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে নিয়ে তার বন্ধু শাহিনুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ইয়ামিনের সঙ্গে আমার ভালোমতো পরিচয়। যদিও আগে থেকেই ওকে চিনি। আমার ফ্লোরেই থাকত, নামাজে দেখা হতো। কিন্তু আগে এত কথা হয়নি। ও থাকত ওর প্রোগ্রামিং আর গেমিং নিয়ে। আমি আমার কাজে। এরপর তো ওর সঙ্গে কথা বলা শুরু হলো। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি। তৃতীয় বর্ষে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা একই রুমে উঠব। আমার দেখা অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মধ্যে একজন ইয়ামিন। চতুর্থ বর্ষেও আমরা একসঙ্গে উঠলাম। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক- এই জ্ঞান ছিল খুব ভালো। স্কুল-কলেজে সেরা ছাত্র ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। বুয়েটে ভর্তি হয়নি, কারণ, ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছাত্ররাজনীতি করতে চায়নি। তবে এমআইএসটি ডিবেট ক্লাব, সাইবার ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রোগ্রামিংয়ে তুখোড় ছিল। কে কত দ্রুত রুবিকস কিউব মেলাতে পারি, এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। ইয়ামিন সব সময় আগে মিলিয়ে ফেলত। ইয়ামিনের আব্বু পড়ালেখার জন্য ওকে দেশের বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে রাজি ছিল না। ইয়ামিন চাইতো দেশেই কিছু করবে।