ঢাকা সোমবার, ১১ আগস্ট ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না নাজমুলের

জুলাই ২০২৪
বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না নাজমুলের

সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত হয়েছেন নাজমুল হাসান। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবার। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজধানীর বনশ্রী এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন নাজমা বেগম (৪৫)। ছেলে নাজমুল হাসান (২১) পড়ালেখার পাশাপাশি ওই হাসপাতালে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। মা-ছেলের আয়ে চলত সংসার। ১৯ জুলাই আফতাবনগরের বাসা থেকে বনশ্রীতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাজমুল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা এখন নির্বাক। বাসায় কেউ গেলেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছেন।

নিহত নাজমুল কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাপাতলি এলাকার সৈয়দ আবুল কায়েসের ছেলে। যদিও তিনি মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রামের মাতুব্বর বাড়িতে থাকতেন। নানাবাড়ি মাদারীপুরেই ছিল তার স্থায়ী ঠিকানা। কাজের সুবাদে মা-ছেলে রাজধানীর আফতাবনগরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাদারীপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রাম। ২৭ জুলাই বিকেলে নাজমুলের নানাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের বড় একটি ঘরের বারান্দায় দেয়ালে পিঠ ঠুকে বসে আছেন নাজমুলের মা নাজমা বেগম। বাড়িতে সুনসান নীরবতা। উঠানে নাজমুলের খালাতো ভাই সুমন কাজী দাঁড়ানো। প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে তিনি বললেন, ‘আমার ভাই আট দিন ধরে কবরে শুয়ে আছে। বাড়ির পাশেই কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।’ নাজমুলের বড় বোন তানজিলা আক্তার (২৬) মাকে বারান্দা থেকে তুলে মেঝেতে থাকা সোফায় বসালেন। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কান?ায় ভেঙে পড়েন তিনি। মেয়ে ও জামাতা সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ছেলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করতে থাকেন। বললেন, ‘আমি ক্যামনে এই যন্ত্রণা সহ্য করব। আমার তো একটাই মানিক আছিল। আমার এই সন্তান ছাড়া তো আর কেউ নাই। কষ্ট কইরা মানুষ করলাম, পড়াইলাম, লেখাইলাম, এখন কী পাইলাম। কী দোষ ছিল আমার মানিকের, গুলি খাইয়া মরতে হইলো। আমি ক্যামনে বাঁচমু, হায় আল্লাহ।’ নাজমা বেগম বলেন, ‘মা-ছেলে একলগে কাম করতাম। বাবজান আমারে কইতো, ‘মা তোমার আর কষ্ট করতে হইবে না। আমি টাকা জমিয়ে বিদাশ যামু, আপু চাকরি করব, তোমার আর কষ্ট থাকব না।’ এগুলো মনে পড়লে আমার বুকের মধ্যে যে ক্যামন করে তা কইতে পারতাছি না। সরকারের কাছে একটা জিনিস চাই, আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’

নাজমুলের স্বজনরা জানান, ঘটনার দিন ১৯ জুলাই দুপুরের খাবার খেয়ে নাজমুল আফতাবনগর থেকে বনশ্রী ফরাজি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে খণ্ডকালীন ফিজিওথেরাপিস্ট ছিলেন। কোটা আন্দোলন ঘিরে ওই দিন ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। নাজমুল সংঘর্ষ এড়াতে গুদারাঘাট এলাকা দিয়ে হেঁটে বনশ্রীর দিকে যাচ্ছিলেন। গুদারাঘাট সেতুতে ওঠার পর গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন বিক্ষোভকারী তাকে উদ্ধার করে গুদারাঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ওই দিন রাতেই তার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে নানাবাড়ি মাদারীপুরে আনা হয়। পরে জানাজা শেষে নানা আব্দুল রহমান মাতুব?রের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নাজমুলের বড় বোন তানজিলা আক্তার বলেন, ‘ভাই চাকরি করে আমাকেও লেখাপড়ার কাজে সহযোগিতা করতেন।

ভাইডাকে যে এভাবে মরতে হইবে, এটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। বুকের ভেতরটায় যে কী হচ্ছে, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। আমাকে ভাইকে কেন গুলি করে মারা হলো, এটার বিচার আল্লাহ ছাড়া কার কাছে দেব?’ খালাতো ভাই সুমন কাজী বলেন, নাজমুল গত বছর ঢাকার ইমপিরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে স্নাতক করছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি হাসপাতালে খণ্ডকালীন কাজ করে ১২ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সহযোগিতা করতেন।

স্বজনরা জানান, জীবিকার তাগিদে ছোটবেলা থেকে ঢাকায় অবস্থান করেন নাজমুল হাসান। পরিবারের হাল ধরতে রাজধানীর ফরাজী হাসপাতালের ফিজিওথেরাপি টেকনিশিয়ান হিসেবে এক বছর আগে চাকরি নেন তিনি। গত ১৯ জুলাই দুপুরে রামপুরার আফতাবনগর এলাকার বাসা থেকে ডিউটির উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। গোলাগুলি ও সংঘর্ষের খবরে সড়কে যান চলাচল না করায় হেঁটে যাবার সময় বনশ্রী এলাকার গোদারা ঘাটের সাঁকোর কাছে পেটে গুলিবিদ্ধ হয় ২২ বছর বয়সি নাজমুল। পরে গুরুতর অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পাশে থাকা এক পথচারী নাজমুলকে উদ্ধার করে নিয়ে যান নাগরিক প্রাইভেট হাসপাতালে। সেখানে কিছুক্ষণ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যান তিনি। ওই রাতেই তার লাশ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার চরগোবিন্দপুর এলাকায়। ২০ জুলাই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নাজমুলকে। নাজমুলের আকস্মিক মৃত্যুকে হতবাক আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত