ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাজারব্যবস্থা ও ইসলাম

তাবাসসুম মাহমুদ
বাজারব্যবস্থা ও ইসলাম

অধুনা পৃথিবীতে প্রচলিত চারটি অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান। ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ, মিশ্র অর্থব্যবস্থা ও ইসলামি অর্থব্যবস্থা। শিল্পবিপ্লবের আগপর্যন্ত ইউরোপে অর্থনীতির ক্ষেত্র বিকশিত হয়নি। কারণ, তখনও পর্যন্ত তাদের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। চরম দারিদ্র ও অভাব-অনটনের মধ্যে তারা দিনযাপন করত। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমাবন্ধ ছিল কৃষিপণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, কেনাবেচা পর্যন্ত। ফলে তাদের বৃহদাকারে শাস্ত্রীয় অর্থনীতি চর্চার সুযোগ ও প্রয়োজন হয়নি। অথচ তখন ইসলামি বিশ্বে শিক্ষা, সভ্যতা ও উন্নয়নের ভরা জোয়ার চলছিল। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে একটি সুসংহত ও বিন্যস্ত রূপদানে সমর্থ হয়েছিলেন।

ইউেরাপে শাস্ত্রীয় অর্থনীতির চর্চা ও সমাজতন্ত্রের বিকাশ : শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশ প্রসার ঘটে। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনা বিনির্মাণ হতে থাকে। তখন কালমার্কস অর্থনীতিতে বিপ্লাবাত্মক এক মতবাদের জন্ম দেয়। যার নাম সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ। যে মতবাদের মূলকথা হলো, ব্যক্তি মালিকানা বলতে কিছু নেই। সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক হলো, রাষ্ট্র বা সরকার। যোগান ও চাহিদা বিধির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র প্রয়োজন মাফিক অর্থনীতি পরিচালনা করবে এবং দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের যুক্তি হলো, অর্থনীতিকে যদি স্বয়ংক্রিয় যোগান ও চাহিদা বিধির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে গুটিকয়েক অসাধুর কারসাজি পুরো বাজারব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে। ফলে সম্পদ গুটিকয়েক পুঁজিপতির হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়বে। আর গরিব-দুঃখী, অভাবী মানুষ অর্থনৈতিক নিষ্পেষনের শিকার হবে। তার এ মতবাদ তখন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কারণ, এর আগে জনগণ পুঁজিপতিদের জুলুমণ্ডঅত্যচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অথচ এ যুক্তি আপত দৃষ্টিতে চমকপ্রদ মনে হলেও একটু গভীর চিন্তা করলে এর ফাঁকফোঁকর ও অসারতা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রেই অনুধাবন করবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিধ মাওলানা আবদুর রহিম (রহ.) তার রচিত ‘ইসলামের অর্থনীতি’ গ্রন্থে বলেন, ‘ধনতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র কেউ জাতিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, মানবজাতির অর্থনৈতিক সমস্যার যথাযথ সমাধান আনতে পারেনি। ধনতন্ত্রের যাঁতাকল থেকে মুক্তির শ্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব হলেও পরবর্তীতে জনগণের কাছে সমাজতন্ত্র ধনতন্ত্রের বিবর্তীত রূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।’

ইসলামি অর্থনীতিতে পণ্যের দামব্যবস্থা : ইসলামি অর্থনীতি ব্যক্তির মালিকানাকে স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ, ব্যক্তিগত মালিকানা একটি স্বভাবজাত বিষয়। স্বাভাবিকভাবে একটি জিনিসকে যখন ব্যক্তি নিজের মনে করে, তখন সে তার প্রতি যত্নবান হয়; এটি সংরক্ষণে তৎপর হয়। নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকায় এর প্রবৃদ্ধির জন্য দিনরাত খাটতে আপত্তি করে না। যখন কোনো বস্তুতে তার মালিকানা থাকে না, তখন সেটিতে সে স্বাভাবিক শ্রম দিতেও অলসতা করে। কোরআনে ব্যক্তিগত মালিকানার সুস্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পুরুষরা যা অর্জন করবে, তা তাদের অধিকারে থাকবে; আর নারীরা যা র্অজন করবে, তা তাদের অধিকার।’ (সুরা নিসা : ৩২)। চাহিদা ও যোগানের স্বয়ংক্রিয় বিধানকেও ইসলাম স্বীকার করে নিয়েছে। অর্থব্যবস্থাকে ইসলাম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন করতে চায়নি। কেননা, এতে ব্যক্তিগত লাভণ্ডক্ষতির বিষয় না থাকায় মেধা ও শ্রম সেই পর্যায়ে কাজ করে না, যে পর্যায়ে ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষতির বিষয় থাকে। আর এতে মেধা ও শ্রমের অপচয় হয় এবং উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহতায়ালা অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকে নিজের আওতাধীন রেখে চাহিদা ও যোগানের স্বয়ংক্রিয় বিধানের অনুগামী করে দিয়েছেন। হাদিসে এ বিষয়ের প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘গ্রাম থেকে আগত বিক্রেতাদের পক্ষ হয়ে শহরবাসী তাদের পণ্য বিক্রয় করে দেবে না। লোকদেরকে তাদের আপন অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৪২)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন।’ তিনি বললেন, ‘বরং আমি দোয়া করব।’ এরপর আরেকজন এসে একই কথা বলল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহই (জিনিসের দাম) কমান-বাড়ান। আশা করি, যেন আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় মিলিত হই, আমার বিরুদ্ধে কারও প্রতি জুলুমের অভিযোগ থাকবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৫০)। এ হাদিসে দ্রব্যমূল্যকে আল্লাহর আওতাধীন বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে এমন এক যুগান্তকারী ব্যবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছেন, যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ হয়। ইসলামি অর্থনীতিবিদরা এ ব্যবস্থাকে যোগান ও চাহিদা বিধি বলে অভিহিত করেছেন। এর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা ও কোনোরূপ অন্যায় হস্তক্ষেপ করা চরম অন্যায় ও জুলুম। এতে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। তাই তো সাহাবায়ে কেরামের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও রাসুল (সা.) পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেননি; বরং যোগান ও চাহিদা বিধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর একে ছেড়ে দিতে বলেছেন।

পুঁজিবাদের প্রতিরোধে ব্যবস্থাপনা : সবকিছুকে সব সময় এ স্বাভাবিক নিয়মের আওতায় পুঁজিপতিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া এভাবে কাম্য নয় যে, তারা যা ইচ্ছে করবে। কেননা, এ শর্তহীন অবাধ স্বাধীনতাই পুঁজিবাদের উৎস। এর ফলে সব সম্পদ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়ে উঠবে। ফলে সামগ্রিক বাজরব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু যদি ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে পণ্য বাজারজাতকরণের স্বাধীনতা দেওয়া না হয়, তাহলে উৎপাদনের গতিশীলতা বিনষ্ট হবে এবং শ্রমের ব্যাপক অপচয় ঘটবে।

ফলে যোগানের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘাটতি দেখা দেবে; যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই ইসলাম উৎপাদনের গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এবং শ্রমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য যোগান ও চাহিদা বিধি মেনে নিয়ে ব্যক্তির মালিকানাকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং স্বাধীনভাবে পণ্য বাজারজাতকরণের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে ব্যক্তি যেন স্বেচ্ছাচারী না হয়ে ওঠে, তার কাছে সব সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে পুঁজিবাদের সৃষ্টি না হয়, সেজন্য ইসলাম তার ওপর কিছু শর্তা ও বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। যেমন- জুয়া, সুদ, পণ্যবিহীন বেচাকেনা ইত্যাদি হারাম হওয়া। যেসব লেনদেন যোগান ও চাহিদার বিধিকে নষ্ট করে, ইসলাম সেগুলোকে নিষেধ করেছে। যেমন- পণ্য মজুদকরণ, শহরের বাইরে গিয়ে আগত ব্যক্তি থেকে পণ্য কিনে নেওয়া, গ্রাম্য ব্যক্তির পক্ষ হয়ে শহরের বাজারে পণ্য বিক্রয় করে দেওয়া, দালালি করা ইত্যাদি। (হেদায়া, কিতাবুল ফাই)। তবে যদি ব্যবসায়ীদের যোগসাজসে কিংবা অবৈধ হস্তক্ষেপে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে ইসলামি সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় বাজারদর নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাষ্ট্র কিংবা সরকারের নেই। ইসলাম একটি জনকল্যাণকামী জীবনব্যবস্থা। সামগ্রিক কল্যাণের মানস থেকেই ইসলামের বিধিবিধান আবর্তিত। তাই ইসলাম ব্যক্তি কল্যাণ থেকে সামগ্রিক কল্যাণকে বেশি প্রাধন্য দিয়েছে। যদি ব্যক্তিগত মালিকানার ফলে সামগ্রিক কল্যাণ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানার বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত